শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণত ছেলেদের ক্ষেত্রে পদবী রাখা হয় 'সিং' এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে পদবী রাখা হয় 'কৌর'। সিংহের মত তেজি হতে হবে বলে সিং এবং রাজকন্যার মত আদুরে হবে বলে কৌর। এটাই রেওয়াজ। কিন্তু 'জাহান গীত সিং'-এর গল্পটা একটু অন্য। তাঁর মা-বাবা মেয়েকে শুধুমাত্রই আদুরে হিসেবে রাজকন্যার তকমা দিতে চাননি। চেয়েছিলেন সিংহের মত দাপিয়ে বেড়াক তাদের মেয়ে চারদিক। তাই মেয়ের পদবী রেখেছিলেন সিং। ভিন্ন ভাবধারার সন্তান হিসেবে সত্যিই জাহান মা-বাবার নাম উজ্জ্বল করতে সক্ষম হয়েছে। মেয়েলি ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে পুরুষদের একাধিপত্যের এলাকায়। 'সর্বকনিষ্ঠ মহিলা ঢোল বাদক' হিসেবে ইতিমধ্যেই জাহান ভারতের একটি পরিচিত নাম।
শুরুটা হয়েছিল মাত্র ১২ বছর বয়সে। পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে 'ঢোল' বাদ্যযন্ত্রটি পছন্দ হয়ে যায় ছোট্ট মেয়েটির। ঢোলের ছন্দে, নাচে নেচে ওঠে তার ছোট্ট মনটিও। আবদার করে মা-বাবার কাছে, সে ঢোল বাজানো শিখবে। প্রগতিশীল অভিভাবক এক কথায় রাজি। তাই কোনো রকম বেগ পেতে হয়নি বাড়ি থেকে। সেই ছোট্টোবেলা থেকে আট কেজি ঢোল-কে শাসন করে বেরিয়েছে জাহান। প্রথম যখন শিখতে গিয়েছিল, সব শিক্ষদের প্রথম প্রশ্নই হত, কে শিখবে? জাহান কে দেখে সকলেই চোখ কপালে তুলতেন? আঁতকে উঠে প্রশ্ন করতেন, "মেয়ে হয়ে ঢোল বাজানো শিখবে? তোমার কোনো লজ্জা বলতে কিছু নেই?" অবশেষে জাহান পেয়েছিল তার শিক্ষক। চার কন্যার পিতা 'সর্দার কর্তার সিং' রাজি হয়েছিলেন তাকে ঢোল শেখাতে।
জাহান রোজ স্কুল থেকে ফিরে উন্মুক্ত মাঠে বেরিয়ে পড়ত ঢোল বাজানো প্র্যাকটিস করতে। ২-৩ ঘন্টা ধরে চলত রেওয়াজ| ঢোল মূলত নাচের সঙ্গে জোরদার তাল, ছন্দ তৈরী করার মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। বিশেষত পাঞ্জাবিদের ভাংড়া নাচের মাধ্যম হিসেবেই জাহান ঢোল বাজানো শিখতে শুরু করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার আওয়াজ হতে হবে বলিষ্ঠ। ছোট্ট হাত যতই জোরে বাজাক না কেন, কিছুতেই যেন সেই বলিষ্ঠতা আসত না। তাই খেতে হত গুরুর বকুনি। কিন্তু সেই বকুনি শুনে দমে যাবার পাত্রী ছিল না জাহান। সে যত বকুনি খেত, ততই জেদ চেপে বসত আরো ভাল বাজানোর। তাই মাত্র ১৪ বছর বয়সেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ঢোল বাদক হিসেবে দেখতে পেয়েছিল সে। সর্বকনিষ্ঠ মহিলা ঢোল বাদক হিসেবে দেশ তথা দেশের বাইরেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিল জাহান।
বর্তমানে ২১ বছর বয়সী জাহান একজন আত্মবিশ্বাসী ঢোল বাদক বলা ভাল 'ঢোল গার্ল অফ ইন্ডিয়া'। তার মা-বাবা এখন মেয়ের গর্বে গর্বিত। তাঁরা ঢোল গার্ল-এর অভিভাবক হিসেবে সব জায়গায় পরিচিত হন। জাহান পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে ল'পাশ করেছে। রাজ্য স্তরের পুরস্কার সহ বহু পুরস্কার তার ঝুলিতে। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে প্রায় ১০০টিরও বেশি অনুষ্ঠানে বাজিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই জাহান। টিভি চ্যানেলেও নিজের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে সে।
মেয়ে হওয়ার প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। সেই ভারী ঢোল সামলানোই ছিল মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। শারীরিক গঠনে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা একটু নরম হয়। কিন্তু তার শিক্ষক কর্তার সিং বলেছিলেন, যদি ঢোল বাজাতেই হয়, শরীরকে সেই ভাবেই তৈরী করতে হবে। ঢোলের তালে নাচ হবে, তাই ঢোল বাদককে দ্বিগুণ এনার্জি নিয়ে ঢোল বাজাতে হবে। বাজানোর সময় এনার্জির কম হলে চলবেনা। ভারী ঢোল প্রথমে নিচে রেখে বাজানো শুরু করেছিল জাহান, তারপর চেয়ারে, তারপর খুব অল্প দিনের মধ্যেই গলায় ঝুলিয়ে ট্র্যাডিশনাল স্টাইলে বাজানো শুরু করে। শুরুর দিকে সে যখন ঢোল নিয়ে পারফর্ম করতে স্টেজে উঠত, তখন উপস্থিত দর্শকাসনে বসে থাকা উৎসাহী সকলে ভাবত, হয়ত কোনো অভিনয় করার জন্য ঢোলের প্ৰয়োজন তাই ঢোল নিয়ে স্টেজে উঠেছে। পরে তার বাজনা শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে যেত। উদ্বেলিত জনতার করতালি ছোট্ট জাহানকে আরো এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করত। সেই অভিবাদন-ই জাহানকে এতদূর এগোতে সাহায্য করেছে।
সমাজের বদ্ধ ধারণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া এই সাহসী মেয়ে তাই বলেন, কোনো কাজ-ই আলাদা করে ছেলেদের কাজ বা মেয়েদের কাজ বলে কিছু হয়না। তিনি সকল অভিভাবকদের তাই অনুরোধ করেন, 'ছেলেদের একটু মেয়েদের মতো নমনীয় হতে শেখান আর মেয়েদের একটু তেজী হতে শেখান ছোট থেকেই, তাহলে আমাদের সমাজে অনেকটাই বদল আসবে'।