একাকীত্ব, অবসাদ কি ক্ষণিকের অবসরে বেড়াতে যাওয়ার নামে বাঙালি এক পায়ে খাড়া। বাহানা আর সুযোগ পেলেই মানুষ বেরিয়ে পড়ছে দূর দিগন্তে। গলিঘুঁজি, পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি, টিলা সর্বত্র এক কথা- ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। হুজুগে বাঙালির দাপটে ট্রাভেল কোম্পানির পকেট ফুলে ঢোল আবার পরিবেশের চরম সর্বনাশও হচ্ছে। তবে বাঙালির এতে হেলদোল নেই। ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে বাঙালি একটা তকমা আদায় করেই ছেড়েছে। আমরাও এই দলে। তাই বেরিয়ে পড়ি সুযোগ মতো। মুসৌরি ছেড়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে আরেক শৈল শহরের দিকে।
সবুজ গালিচা মোড়া উপত্যকা, পাহাড়ি নদী আর পাতায় পাতায় গাছেদের ফিসফাস আর নানা রঙের, নানা প্রকারের বিচিত্র দর্শন পাখি আমাদের সঙ্গী। পাহাড়ের বুক চিরে যে পথ গিয়েছে সেই পথ ধরে আমাদের এগিয়ে চলা। পাহাড়ের এই পাকদন্ডী পথে সৌন্দর্যের শেষ নেই। এই যাত্রাপথ এমন এক অনিন্দ্যসুন্দর পথ যা স্মৃতির কুলুঙ্গিতে মন ক্যামেরায় আজীবন বন্দি থাকবে তা হলফ করে বলতে পারি।
মুসৌরি থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরী ধনৌলটি। যে কোনো শৈলশহরের সঙ্গে টেক্কা দিয়েও ধনৌলটি কিন্তু প্রথমদিকের সারিতেই থাকবে। নববিবাহিত দম্পতি কিংবা বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতী, প্রৌঢ় প্রৌঢ়ার আদর্শ মধুচন্দ্রিমা যাপনের কেন্দ্র ধনৌলটি। প্রেমকে রিচার্জ করে নেওয়ার জন্য একবার এখানে পা দিয়ে দুদিন কাটিয়ে যেতেই হবে।
মুসৌরি চাম্বা রোডে মুসৌরি থেকে মাত্র ৩১ কিলোমিটার দূরে ধনৌলটি। হিমালয়ের কোলে এক নির্জন সবুজ উপত্যকা। পুরো রাস্তাই আপেল, দেওদার, ওক, রোডোডেনড্রোন গাছে ছাওয়া। পাহাড়ের উপত্যকাটি ঘন জঙ্গল কিন্তু গাছগুলো অদ্ভুত সারিবদ্ধভাবে বেড়ে উঠেছে। প্রকৃতির নিপুণ হাতের স্পর্শে হয়ে উঠেছে রূপকথার মায়াপুরী।
এপ্রিল-মে মাসে রোডোডেনড্রোনের ফুলের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। শিরশিরে ঠান্ডা, পাহাড়ি নির্জনতা আর গাছের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, গাছের তলায় সবুজ গালিচা বিছানো, শুকনো পাতার সমাহার আর নানা রঙের ফুলের বুটির কোলাজ, মন যেন কোনও এক অচিন জগতে পৌঁছে দেয়। গাড়ি যে কখন ধনৌলটি পৌঁছে গিয়েছে টেরও পাইনি। থাকার মতো কয়েকটি হোটেল আছে। তার মধ্যে গাড়োয়াল বিকাশ মন্ডল নিগমের হোটেলেই ছিলাম। দামে একটু চড়া কিন্তু ব্যবস্থাপনা খুব সুন্দর। বাঙালি রান্না পাওয়া মুশকিল কিন্তু খাদ্যের অভাব নেই।
দেখার মতো জায়গা হলো প্রকৃতিবীক্ষন কেন্দ্র, ভেষজ উদ্যান, বার্ড ওয়াচিং ব্যবস্থা। জিএমভিএন বাংলোর বিপরীতেই রয়েছে ভেষজ উদ্যান। পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়ানো আর দূরে বান্দরপুঁছ, শ্রীকণ্ঠ, কেদারনাথ শৃঙ্গ দেখে নেওয়া। শ্বেতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গগুলি ধ্যানস্তব্ধ মৌন হয়ে শায়িত। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের শোভা মনের মনিকোঠায় চিরকালের জন্য ভাস্বর হয়ে থাকে। ছবি তোলার শখ না থাকায় ছবিগুলো মন ক্যামেরায় আজও বন্দি।
চোখ জুড়ানো সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে গাড়ি বা বাস ধরে তিন কিলোমিটার দূরে কাদ্দুখাল চলে যাওয়া যায়। ওখান থেকে তিন কিলোমিটার চড়াই উঠে সুরখন্ডা দেবীর মন্দির। দেওদার গাছে ছাওয়া অনিন্দ্যসুন্দর মন্দির। অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে পাথর দিয়ে তৈরি মন্দির। প্রকৃতি আর স্থাপত্যের অদ্ভুত মেলবন্ধন। মন্দির চত্বরটিই হিমালয় দর্শন করার গ্যালারি। দেবী সতীর শির এখানে পড়েছিল এরকমই পৌরাণিক কাহিনী এই মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত। দেবী দুর্গা পূজিত হন। প্রকৃতি আর অধ্যাত্ম মিলেমিশে একাকার। দেবী দুর্গার এই মন্দির দেখে পাহাড়ি পায়ে চলা হাঁটা পথে গাড়োয়ালের গ্রাম দেখতে দেখতে ফিরে আসা।
চারিদিকে ওক, পাইন, দেওদার, রোডোডেনড্রোন গাছে ছাওয়া। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আমরা পথে চাম্বা জেলায় রোডোডেনড্রোনের শরবত একটু চেখে নিলাম। চাইলে নিয়েও আসা যায়। অকৃত্রিম রোডোডেনড্রোনের শরবত পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়, সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর পানীয়র স্বাদ পাওয়া বাড়তি পাওনা। অতুলনীয় স্বাদ গ্রহণ করে বাড়তি ইচ্ছেপূরণ হল, তাই পাউরিতে না গিয়ে আমরা আবার চেনা পথে গন্তব্যের দিকে। গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিলাম নিজ বাসভূমে ফেরার জন্য।
শুরু হল পাহাড়ি পথে চলা। দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে চলেছে। আমাদের সঙ্গী কখনও ঘন জঙ্গল, নানা ধরণের গাছ গাছালি, রং বেরঙ্গের ফুল, প্রজাপতি, পাহাড়ি ঝর্ণা, দুরন্ত গতিতে বয়ে যাওয়া নদী আর একদিকে অতলস্পর্শী গভীর খাদ। আবার কখনও একের পর এক পর্বত, পাহাড় আর নানারঙ্গের ভূপ্রকৃতি। বৈচিত্রময় প্রকৃতির রূপ আস্বাদন করতে করতে মন ও নানা রঙে রঙিন।
হিমালয়ের ঝর্ণার বয়ে যাওয়া কলতান, পাইন, দেওদার, ওক, রোডোডেনড্রোনের পাতায় পাতায় ফিসফাস আর পাহাড়ের মৌনতা, পাহাড়ি জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় আর হাজার পাখির কলতান, প্রকৃতির সিম্ফনি আর রং বেরঙ্গের প্রজাপতির সমারোহে হারিয়ে যাই আমরা প্রকৃতির কাছে। কয়েকটা দিনের বিশ্রাম, অবকাশ যাপন করে আবার ফিরে চলা শহরের টানে। পিছনে পড়ে থাকে তুষার শুভ্র হিমালয়, হাজার রঙের মিশেলে তৈরি জঙ্গলের ক্যানভাস আর রজতশুভ্র তাজ পরিহিত মৌন মুখর পর্বতশৃঙ্গের অতল আহ্বান। বোধ করি যুগযুগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদেরই অপেক্ষায়।