আজ ধনতেরাস, আজ উৎসব পার্বণের দিন। আজ থেকেই শুরু দীপাবলির উৎসব। সারা দেশ জুড়েই পালিত হয় ধনতেরাস। এইদিন ধনদেবী লক্ষ্মী এবং গণেশের পুজো করা হয়। ধন দেবতা কুবেরেরও পুজো করা হয় এই দিনে। আলোর উৎসব দীপাবলি চলে পাঁচ দিন ধরে, তারই অঙ্গ হল এই ধনতেরাস। ধন শব্দের সম্পদ, তেরাস অর্থাৎ তের; এই দুই মিলেই ধনতেরাস শব্দের সৃষ্টি। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে অর্থাৎ ১৩তম দিনে হয় ধনতেরাস। যা ধন ত্রয়োদশী অথবা ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী নামেও পরিচিত।
আবার অনেকেই একে ধন্বন্তরী জয়ন্তী বা ধনবত্রী ত্রয়োদশী বলেন। ব্যবসায়ীদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। বাড়িতে ও দোকানে মহাসমারোহে এই দিনটিকে উদযাপন করেন সকলে। জ্যোতিষ মতে, ধনতেরাস অত্যন্ত শুভ দিন। ধনতেরাসে বিশেষ শুভ যোগ থাকে, সেই কারণে এই দিনে পুজো ও কেনাকাটা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, এদিন সোনা, রুপো বা ধাতু কিনলে পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। গৃহস্থ বাড়িতেও এই দিনে উৎসব উদযাপন করা হয়।
লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়, গণেশকে লাড্ডু নিবেদন করা হয়। ঘিয়ের প্রদীপও জ্বালান অনেকে। দীপাবলির দিন অলক্ষ্মীকে বিদায় করে লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়, তার দুদিন আগেই হয় ধনতেরাস। পরিবারের মঙ্গল, সুখ সমৃদ্ধি এবং আর্থিক উন্নতির জন্য এই দিনকে সবাই পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চলতি বছর ধনতেরাসে ত্রিপুষ্কর ও সিদ্ধ যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যা এই উৎসবের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
এই দিন মূল্যবান ধাতু কেনার ধুম পড়ে যায়। সোনার-রূপোর গহনার দোকানে চলে নানান আকর্ষণীয় অফার। প্রচলিত বিশ্বাসে মনে করা হয়, ধাতু কিনলে তার জৌলুসে আকৃষ্ট হয়ে মা লক্ষ্মী নিজেই সেই বাড়িতে আসেন। অনেকেই এই সমৃদ্ধির বিশ্বাসে, এ দিন সোনা বা রূপোর গয়না, গিনিকয়েন বা প্রতীকী কিছু কেনেন। এই তিথিতে সোনা-রূপো কেনা শুভ বলে মনে করা হয়।
যদিও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য যেকোনও ধাতব জিনিস কেনাই রীতি। যারা দামি ধাতু কিনতে পারেন না তারা নিদেন পক্ষে পিতল, তামার দ্রব্য কেনেন। তাও না পারলে অনেকেই স্টিলের নতুন বাসনপত্র কিনে থাকেন। এছাড়াও এদিন নতুন জামা কাপড় কেনা হয়। বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা হয়, প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরের অন্ধকার দূর করা হয়। ধনতেরাস উপলক্ষ্যে লক্ষ্মীদেবীর পাশাপাশি ধন্বন্তরির আরাধনাও করা হয়। মনে করা হয়, ধনতেরাসের দিন দেবী লক্ষ্মী ভক্তদের গৃহে যান ও তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেন।
কিন্তু কীভাবে শুরু হল এই উৎসব... তা নিয়ে নানান পৌরাণিক মত প্রচলিত রয়েছে। একটি মতানুযায়ী, কার্তিক কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পূজিত হন ধন্বন্তরী। সমুদ্র মন্থনের সময় অমৃত কলস হাতে যাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই কার্তিক ত্রয়োদশী তিথিতেই সমুদ্র মন্থনে জন্ম নিয়েছিলেন ধন্বন্তরী। ধন্বন্তরী আসলে বিষ্ণুরই আরেক রূপ, তিনি দেবতাদের চিকিৎসক। মর্ত্যে রোগবালাইয়ের বিনাশ ঘটিয়ে বিজ্ঞান ও ঔষধির বিস্তারের জন্য ধন্বন্তরীর রূপ নেন বিষ্ণু। তিনি আয়ুর্বেদের আরাধ্য ইশ্বর। এই মতে, ধন্বন্তরীর আবির্ভাব তিথিই হল ধনতেরাস।
তার দুদিন পরেই ক্ষীরসাগরে মন্থনে উঠে আসেন মহালক্ষ্মী। এর জন্যই দীপাবলির দুদিন আগে ধনতেরাস পালন করা হয়ে থাকে। অমাবস্যার অন্ধকার থাকায় লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানে আলোয় সেজে ওঠে স্বর্গ। বলা হয়, ধনতেরাসের দিন, একদিকে কালী করেন অশুভ শক্তির সংহার করে আর অপরদিকে শ্রীবৃদ্ধি নিয়ে আসেন লক্ষ্মী। এই বিশ্বাসই কিন্তু ধনতেরাসের দিন সোনা রূপো বা যেকোনও ধাতব বাসনপত্র কেনার নেপথ্য কারণ।
আবার ধনতেরাসের ইতিহাস খুঁজতে আমাদের চলে যেতে হয় পুরাণে। কথিত আছে, একদা দুর্বাশা মুনির অভিশাপে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হতে হয় দেবী লক্ষ্মীকে। তিনি সাগরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। স্বর্গ ছেড়ে লক্ষ্মী চলে যাওয়ায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে স্বর্গরাজ্য। দেবী লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন দেবতারা। রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেবতারা ফিরে পান দেবী লক্ষ্মীকে।
আবার অনেকে মনে করেন হিম রাজা ছেলের জীবন ফিরে পাওয়ার ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ধনতেরাসের উৎস রহস্য।
প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী, রাজা হিমের পুত্রের জীবনে এক অভিশাপ ছিল। তার কুষ্ঠিতে লেখা ছিল, বিয়ের চার দিনের মধ্যে সর্প দংশনে তার মৃত্যু হবে। হিমরাজের পুত্রবধূ সে কথা জানতে পেরে, সেই অভিশপ্ত দিনে তার স্বামীকে ঘুমোতে দেয়নি।
শয়নকক্ষের বাইরে সে নিজের সমস্ত গহনা এবং সোনা-রূপার মুদ্রা জড়ো করে রাখে। সেই সঙ্গে সারা ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়। স্বামীকে সারারাত জাগিয়ে রাখতে সে গল্প শোনায়, গান শোনায়। পরের দিন যখন যম তাদের ঘরের দরজায় আসে, আলো আর গয়নার জৌলুসে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রাজপুত্রের শয়নকক্ষ পর্যন্ত যম পৌঁছন ঠিকই। কিন্তু সোনার উপর বসে গল্প আর গান শুনেই তাঁর সময় কেটে যায়। কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই সকালে ফিরে আসেন যম। রাজপুত্রের প্রাণ রক্ষা পায়। পরদিন সেই আনন্দে ধনতেরাস পালিত হয়।
ধনতেরাসের সন্ধ্যায় শুভক্ষণে পুজোর পর বাড়ির প্রবেশদ্বার ও আঙিনায় প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা রয়েছে। এই প্রথার পিছনেও রয়েছে হিমরাজের পুত্রের গল্প, তবে অন্য এক আঙ্গিকে।
ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী বিয়ের চার দিন পরে হিমপুত্রের প্রাণ নিতে আসা যমদূত, যখন প্রাণ নিতে যাচ্ছিলেন, তখন নববিবাহিতা স্ত্রীর কথা শুনে যমদূতের হৃদয়ে আঘাত লাগে। কিন্তু বিধি অনুযায়ী নিজের কাজ করতে তিনি বাধ্য। যমদূত যখন যমরাজকে এই কাহিনি শোনাচ্ছিলেন, তখনই অন্য এক দূত আবেদন জানান যে, ‘হে যমরাজ! এমন কোনও উপায় কী নেই, যা করলে মনুষ্য অকাল মৃত্যুর হাত থেকে মুক্ত হবে।’ তখন সব শোনার পর যমরাজ বলেন, ‘হে দূত! অকাল মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তির একটি সহজ উপায় আমি তোমায় জানাচ্ছি, শোনো। কার্তিক কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর রাতে যে প্রাণী আমার নামে পুজো করে দক্ষিণ দিকে দীপমালা অর্পণ করবে, তার অকাল মৃত্যুর ভয় থাকবে না।’ এই কারণেই এই দিন বাড়ির দক্ষিণ দিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়।