কালী কথা: ধন্বন্তরী কালী বাড়ি, যে মন্দির পুজো দিলেই আরোগ্য লাভ

বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কালীক্ষেত্র, এক একটি মন্দির ঘিরে কিংবদন্তির অন্ত নেই। কোনও কোনও মন্দির গেলে রোগ নিরাময় হয় বলেও, স্থানীয়দের বিশ্বাস। আজকের কালী কথায় তেমনই এক মন্দিরের কথা বলব। মন্দিরটি দক্ষিণ ২৪ পরগনায় অবস্থিত, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মজিলপুরে। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার জয়নগরগামী যেকোনও ট্রেনে জয়নগর-মজিলপুর স্টেশনের ১নং প্ল্যাটফর্মে নেমে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ, কয়েক পা এগোলেই চোখে পড়বে ধন্বন্তরী কালী বাড়ি। ধন্বন্তরী মন্দির নামের কারণ, কথিত আছে ৪০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরে দেবীর স্বপ্নাদেশ থেকে পাওয়া ওষুধ দেওয়া হয়। যা খেয়ে অসুস্থ, রোগে কাতর ভক্তরা সুস্থ হয়ে যান। ভক্তদের বিশ্বাস, গ্যাস, অম্বল থেকে শুরু করে বহু ভয়ানক রোগ দেবীর স্বপ্নাদেশে পাওয়া ওষুধ খেলে সেরে যায়। সেই কারণেই দেবীর নাম ধন্বন্তরী। তিনি স্বর্গের বৈদ্যরাজ ধন্বন্তরীর মতোই যেন রোগ সারিয়ে দিচ্ছেন। ভক্তরা দেবীকে ধন্বন্তরী নামেই ডাকেন। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে আদিগঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলগুলো ছিল গভীর জঙ্গলাকীর্ণ ও নিরিবিলি। ফলে লোকালয় থেকে দূরে সেই সব স্থানেই তন্ত্রসাধকরা গড়ে তুলেছিল শক্তিসাধনার ক্ষেত্র। তেমনই এক সাধনক্ষেত্র আজকের ধন্বন্তরী কালী বাড়ি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কথা, আঠারো শতকের প্রথম ভাগে গঙ্গাসাগরগামী আদি গঙ্গার ধারা বর্তমান মজিলপুর গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হত। জয়নগর-মজিলপুর গ্রাম দুটির মধ্যে মোয়ার পীঠস্থান জয়নগর গ্রামটি বহু প্রাচীন। জয়নগরের পূর্ব দিকে মজিলপুর গ্রাম অবস্থিত, এই গ্রামটি জয়নগর অপেক্ষা বয়সে নবীন। প্রাচীন কালে এর অস্তিত্ব ছিল না, তখন সেখানে ভাগীরথী অর্থাৎ আদিগঙ্গা প্রবাহিত হত। মনে করা হয়, আদিগঙ্গা মজে গিয়ে স্থানটি সৃষ্টি হাওয়ায় নাম হয়েছে মজিলপুর। মজিলপুর পদ্মপুকুর নামেও খ্যাত। এককালে আদিগঙ্গার পাড়ে বিভিন্নস্থানে শ্মশান ছিল। আজকের যেখানে ধন্বন্তরি কালী মন্দিরের অবস্থান, সেখানেও শ্মশান ছিল। সে সময় জনৈক ভৈরবানন্দ নামে এক তান্ত্রিক সাধক ভাগীরথী অর্থাৎ গঙ্গার ধারার মাঝে তৈরি হওয়া চরার উপর বসে সাধনা করত, বর্তমানে যেখানে মজিলপুরের ধন্বন্তরী কালী মন্দির অবস্থিত, সেখানেই ছিল তান্ত্রিক ভৈরবানন্দের সাধনক্ষেত্র। একদিন তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, দেবী বলেন পাশের পদ্মা পুকুরে তিনি পড়ে রয়েছেন, তাকে উদ্ধার করে পুজো করার নির্দেশও দেন দেবী। পুকুরে সন্ধান করে, জলাশয়ের এক কোন থেকে কালো পাথরের কালী মূর্তি খুঁজে পান ওই তান্ত্রিক। মাতৃ আদেশ মতো, এক খড়ের চালার কুটিরে মূর্তির পুজো আরম্ভ করেন তিনি। পাথরের মূর্তির বয়স প্রায় তিনশো বছর।

ডায়মন্ডহারবারের নেতরা গ্রামের জনৈক রাজেন্দ্র চক্রবর্তীকে মজিলপুরে নিয়ে এসে, তাঁকে ওই কালী মূর্তি পুজোর দায়িত্ব দেন ভৈরবানন্দ। আর নিজে সাধনার উদ্দেশ্যে অন্যত্র চলে যান। মজিলপুরের ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ ছিলেন রাজেন্দ্রলাল চক্রবর্তী। তিনি তন্ত্রসাধক ভৈরবানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সময়টা সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ। সেই সময়েই একদিন রাজেন্দ্রলাল রায়কে স্বপ্নে দেখা দেন দেবী ধন্বন্তরী। পুকুরের কাছে পড়ে থাকা একটি নিম কাঠ থেকে দেবী বিগ্রহ তৈরির আদেশ দেন, নির্মিত হয় নিম কাঠের বিগ্রহ। আজও এই নিমকাঠের বিগ্রহ পূজিত হচ্ছে মন্দিরে। রাজেন্দ্র চক্রবর্তীর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে মা কালী তাঁকে একটি বাতের ওষুধ দেন, যা পানের মধ্যে দিয়ে খেলে বাত সেরে যায়। ধন্বন্তরী মতো ওই ওষুধ কাজ করত বলে, সেই থেকেই কালী বিগ্রহটি ধন্বন্তরী নামে পরিচিত হয়, মন্দিরের নাম হয় ধন্বন্তরী কালী বাড়ি। মন্দিরে মায়ের নিত্য পুজো হয়, এছাড়াও প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। রোগমুক্তির জন্য কাতারে কাতারে ভক্ত মায়ের পুকুরে স্নান করে ওষুধ খায় ও পুজো দেয়। ক্রমেই খড়ের চালের মন্দিরের বদলে, প্রায় দেড় শতাব্দী আগে পাকা মন্দির গড়ে ওঠে। আদি পাথরের মূর্তির অনুকরণে একটি কাঠের মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করা হচ্ছে। প্রতি বৈশাখ মাসের শুক্ল প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত ওই দারু মূর্তিতে ১৬টি বিভিন্ন মাতৃদেবীর মূর্তির রূপদান করা হয়। এই রূপদানকেই স্থানীয়ভাবে বেশ বলা হয়, সেই উপলক্ষ্যে যে মেলা হয়, তাকে বেশের মেলা বলা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এই বেশের মেলা দেখতে ভিড় জমান।

মায়ের মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি শিব মন্দির, স্মরণাতীত কাল থেকেই শিব বিরাজমান। তিনিই মায়ের ভৈরব। মন্দিরের সঙ্গে আরও এক শিব লিঙ্গও পূজিত হয়। পাশে একটি শনি দেবতার মন্দিরও রয়েছে। প্রতি শনিবার কালী মন্দিরে হাজার হাজার মানুষ পুজো দেন। মায়ের আদ্যাশক্তির অনুকরণে একটি দারুমূর্তি পূজিত হয়। ওই মূর্তিকেই বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের সন্ধ্যায় হাত, পা, অঙ্গ, বদলিয়ে চণ্ডী মতে ১৫টি বেশে সাজানো হয়। বসে মহামেলা। মেলাটি বেশের মেলা নামেই খ্যাত। জয়নগরের বেশের মেলা বা ধন্বন্তরী মন্দিরের এই মেলা খুবই জনপ্রিয়। কালী মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। গর্ভমন্দিরে বেদির উপরে রয়েছে একটি কারুকার্যখচিত কাঠের রথসিংহাসন। তাতে পদ্মের উপরে শুয়ে আছেন মহাদেব। তাঁরই বক্ষস্থলে দাঁড়িয়ে দেবী কালিকা। মহাদেবের মাথাটি দেবীর সামনের দিকে। শ্রীচরণে মল, দু'টি কান কুণ্ডল শোভিত। দেবীমূর্তির পাশে দুটি ঘরে রয়েছে দুটি শিবলিঙ্গ। দেবীর মূর্তিটি নিমকাঠ দিয়ে নির্মিত। দেবীর গাত্র বর্ণ কালো। তিনি বসন পরিহিতা। দেবীর এলানো কেশ কোমর ছাড়িয়ে, তিনি ত্রিনয়নী দক্ষিণাকালী। দেবী অলঙ্কারে সজ্জিতা। দেবীর একহাতে রয়েছে খাঁড়া, অন্য হাতে রয়েছে নরমুণ্ড। পাশাপাশি দেবী বরাভয় প্রদান করছেন। দেবীর পদতলে রয়েছেন শিব। বংশপরম্পরায় চক্রবর্তী পরিবার এই মন্দিরের পৌরহিত্যের কাজ সামলে আসছে। চক্রবর্তীদের পূর্বপুরুষ রাজেন্দ্রলাল চক্রবর্তীর সময় থেকেই দেবীর আরাধনা হয়ে আসছে।

তবে এই মন্দিরকে ঘিরে আরও এক কিংবদন্তি রয়েছে। মন্দিরটি সাড়ে তিনশো থেকে চারশো বছরের প্রাচীন। আদিগঙ্গা সংলগ্ন স্থানেই বিরাট এক শ্মশান ছিল। সেখানে বসবাস করতেন এক সন্ন্যাসী। তিনিই মা ধন্বন্তরীর সেবা করতেন। নদী মজে যাওয়ার আগে নদীপথেই বাণিজ্য করতেন দেশ-বিদেশের বহু জমিদার। একদা বাণিজ্য করতে গিয়ে রাত হয়ে যাওয়ায় কোনও এক জমিদার ডাকাতের ভয়ে নদীবক্ষে নোঙর করে, সন্ন্যাসীর কুটিরে আশ্রয় নেন। মাকে দেখে তার ভক্তি জন্মায় ও তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বহু বছর ধরে দেবীর দৈব্য ওষুধে রোগ নিরাময় হওয়ায় ভক্ত সমাগম বাড়তে থাকে। মাকে ঘিরে সেই থেকে রূপ পরিবর্তন শুরু। নিয়ম মেনে এখনও প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রতিপদ থেকে পূর্নিমা পর্যন্ত এক পক্ষকাল ধরে এই রূপ পরিবর্তন ও বিশাল মেলা চলে আসছে। মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ।

রূপ পরিবর্তনের তালিকা

প্রতিপদ কৌমরী

দ্বিতীয়া বিপদত্তারিনী

তৃতীয়া ভুবনেশ্বরী

চতুর্থী গণেশ জননী

পঞ্চমী কৃষ্ণকালী

ষষ্ঠী বারাহী

সপ্তমী নরসিংহী

অষ্টমী সঙ্কটাকালী

নবমী জগদ্ধাত্রী

দশমী আহ্নবী

একাদশী অন্নপূর্ণা

দ্বাদশী কালিয়াদমন

ত্রয়োদশী ইন্দ্রানী

চতুর্দশী দক্ষিণাকালী

পূর্ণিমা ষোড়শী

এই ষোড়শী রূপটি তিন দিন থাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...