কলকাতার এক মেসবাড়ি। দাদার সামনে বসে এক তরুণ। দাদা তাঁকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সংকীর্ণ মানসিকতা, কুসংস্কার মুক্ত ভারতবর্ষের স্বপ্ন। ব্রিটিশ শৃংখল-মুক্ত ভারতবর্ষের স্বপ্ন। আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব স্বপ্ন। ওই তরুণের চোখে। ওই তরুণ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তাঁর দাদা দেশ সেবায় ব্রতী।
রোজ সন্ধ্যেবেলা দাদার মেসবাড়িতে বসতো এই অভিনব 'শিক্ষা'র আসর। দাদার অন্তরের দেশপ্রেম ছড়িয়ে পড়েছিল সেই তরুণ ছেলেটির মনেও। কিন্তু বিধি বাম। দাদার দেশসেবামূলক কার্যকলাপ পুলিশের গোচরে এলো। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে দাদাকে। বাধ্য হয়ে দাদা জদু গোপাল মুখোপাধ্যায় পালিয়ে গেল।
এদিকে দুই সন্তানের দুশ্চিন্তায় চিন্তিত বাবা-মা সত্ত্বর ডেকে পাঠালো সেই তরুণকে। তমলুকের কাছেই জঙ্গলের কাছে এক প্রত্যন্ত গ্রাম কাজাঙ্গল। সেখানেই তাঁদের বাড়ি। বাড়ি ফিরে যন্ত্রনায় দগ্ধ হতে লাগলেন সেই তরুণ। কুসংস্কার, চিন্তাভাবনার অধোগতি তাঁকে কষ্ট দিত। দাদার কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন ভাই। বাবা-মা তাঁদের সন্তানের মনোভাব বুঝে তাঁকে পাঠালেন আমেরিকা। পড়াশোনা করার জন্য। এক টুকরো ভারতবর্ষকে অন্তরে নিয়ে পশ্চিমের দেশে পাড়ি দিলেন ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়। 'দ্যা ম্যান অফ লেটার্স'।
আমেরিকা গিয়েও তাঁর কিছুতেই মন বসে না। দেশের মানুষের কথা ভেবে মন উথাল-পাথাল। ক্ষতবিক্ষত। ছায়া বড় প্রয়োজন ছিল তাঁর। কোথায় পাবেন তিনি তেমন আশ্রয়? অক্ষরে খুঁজে নিলেন সেই পরশপাথর। সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখি শুরু করলেন।
ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় মনে করতেন পৃথিবী তখনই সঠিক পথে এগোতে পারে যখন তার আগত প্রজন্ম সঠিক দিশা পায়। তাই তিনি শিশুদের জন্য বই লেখা শুরু করলেন। তাঁর ছোটবেলা জুড়ে প্রকৃতির অবদান ছিল অসীম। সেই প্রকৃতি নিয়ে শুরু করলেন লেখা। নানা প্রাণী, জঙ্গল-জীবন, পশু-পাখিদের নিয়ে গল্প লেখা শুরু করলেন। তমলুকের কাছে যেখানে তাঁর বাড়ি, আশেপাশেই ঘন জঙ্গল। পশু পাখিদের আনাগোনা অবাধ। ছোটবেলা থেকেই ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়ের কল্পনা শক্তি ছিল প্রখর। তাঁর 'ফিয়ার্স ফেস' গল্পে একটি বাঘের বড় হয়ে ওঠাকে নিখুঁত চিত্রায়ন করা হয়েছে।
এরকম আরেকটি গল্প কারি নামের একটি হাতিকে নিয়ে। 'কারি: দ্যা এলিফ্যান্ট'। পশুপাখিদের আবেগ, অনুভূতি তাঁর লেখায় সুস্পষ্ট।
পাশ্চাত্যে গিয়েও পূর্ব-দেশের গল্প শোনাতে লাগলেন। অভিভূত হয়ে শুনেছিলেন আমেরিকাবাসীরা। তাঁর প্রত্যেকটি বই, লেখা পশ্চিমের মানুষের মন ছুঁয়েছিল। ১৯১০ সালে জাপান পৌঁছেছিলেন এই লেখক। জাপানে তিনি শিল্প সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। শিল্পের সঙ্গেও তিনি আত্মার যোগ খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন। ব্যর্থ হন সেখানেও। যে সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার কর্মীরা দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাদের বদলে নতুন কর্মী নিয়োগ করা ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। ভালোবাসা, সহানুভূতির এমন অবমাননা মেনে নিতে পারেননি সংবেদনশীল মানুষটি। তাই হঠাৎ করে একদিন চেপে বসেন সানফ্রান্সিসকোর জাহাজে। সেখানে পৌঁছে শিশু সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন।
বুঝতে পেরেছিলেন অক্ষর এবং শব্দ ছাড়া তিনি অপূর্ণ। লেখার মাধ্যমেই নিজের জীবনের যাবতীয় অপূর্ণতা উগরে দিয়েছিলেন। বিদেশে সাহিত্য চর্চা করা প্রথম শিশুসাহিত্যিক ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়। আমেরিকার সর্বোচ্চ শিশুসাহিত্যের পুরস্কার
'নিউবেরি মেডেল' দিয়ে ভূষিত করা হয় তাঁকে।
তাঁকে উপাধি দেওয়া হয় 'দ্যা ম্যান অফ লেটার্স'। তিনিই দেশের বাইরে প্রথম এই সম্মানে ভূষিত ভারতবাসী।
১৮৯০ সালের ৬ ই জুলাই ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। বাবা ছিলেন উকিল। মা গৃহবধু। রক্ষণশীল পরিবার। দাদা জদু গোপাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন ব্যতিক্রম। সকল শৃংখল ভেঙে সেবা করতে শুরু করেছিলেন দেশের। সুচিন্তায় ভারতবর্ষের উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন জদু গোপাল মুখোপাধ্যায়। ভাই ধন গোপাল তখন আমেরিকায়। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত কোনরকম ট্রায়াল' ছাড়াই তাঁর দাদাকে পুলিশি হেফাজতে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
দাদার প্রতি এমন অবিচারে ভাইয়ের অন্তরাত্মা তখন ক্ষতবিক্ষত। লড়াই, সংগ্রাম জীবনের পরিপন্থী, এমন ধারনাতেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তাঁর সেই ধারণাকেই বিশ্বাসে পরিণত করল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন আমেরিকায়। বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি তাঁকে মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত করে তুলেছিল।
বিশ্বযুদ্ধের সময় পায়রাদের জীবন বাঁচানোর কৌশল আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে। মৃত্যুর মাঝে লুকিয়ে থাকা জীবনের বীজ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন তিনি। যুদ্ধমুক্ত এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন। এই স্বপ্ন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন।
'দ্যা গে নেক: দ্যা স্টোরি অফ অ্যা পিজিয়ন' এই বিষয়ের উপর তাঁর লেখা বই। একটি যুদ্ধ-পায়রা কিভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের জীবন বাঁচাত সে নিয়েই এই কাহিনী। এছাড়াও তিনি কবিতা, নাটক, ছোট গল্প লিখেছিলেন।
তিনি মনে করতেন যুদ্ধ বিষের সমান। মানুষের মনে ভয়ে সঞ্চারিত করার চেয়ে অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে যুদ্ধের, তাও বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হতে পারে। তাই যুদ্ধ মুক্তি একান্ত প্রয়োজন।
দাদার জীবন নিয়ে ধন গোপাল মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন 'মাই ব্রাদার্স ফেস'।
ধন গোপাল ১৪ বছর বয়সে পৌরহিত্য শুরু করেছিলেন পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু সেই সময় ব্রাহ্মণদের কুসংস্কার, সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা তাঁর আত্মাকে বিদ্ধ করেছিল। তিনি নিজের পৌরোহিত্য শুরু করেছিলেন ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে। তাঁর আত্মজীবনী 'কাস্ট এন্ড আউটকাস্ট'-এ ভারতবর্ষের মানুষের অন্ধবিশ্বাস নিয়ে নিজের কষ্ট ব্যক্ত করেছেন।
ধনো গোপাল মুখোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত বইগুলো হল 'ঘোন্ড: দ্যা হান্টার', 'দ্যা চিফ অফ দ্যা হার্ড', 'হিন্দু ফেবলস ফর লিটল চিল্ড্রেন', 'রামা, দ্যা হিরো অফ ইন্ডিয়া', 'দ্যা মাস্টার মাংকি'।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন পড়াশোনা করেছিলেন ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়।
তিনি প্রথম ভারতবাসী যিনি বিদেশে গিয়ে এভাবে সাহিত্যচর্চা করেছিলেন। পাশ্চাত্যের শিশুসাহিত্যের উজ্জলতম এই জ্যোতিষ্ককে বিশেষ সাহিত্য সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল ওদেশে। মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই জীবন থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। তাঁর জীবন, সাহিত্যকর্ম, চিন্তাভাবনা অবহেলা আর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেও তাঁর সৃষ্টিরা নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল। আজও।