এপারে গঙ্গা আর ওপারে পদ্মা। শতাব্দী প্রাচীন তিলোত্তমা সুন্দরী তো ওপারে পুরনো গন্ধমাখা অলিগলির শহর ঢাকা। তবে দুই দেশ, দুই শহরে বিরিয়ানি কিন্তু কমন। আরও অনেক কিছু মিলের মধ্যে এই খাবারটির স্বাদের বিষয়ে সকলেই কিন্তু একবাক্যে নাম শুনেই বাহবা করে ওঠেন।
আমরা সবাই জানি বিরিয়ানি মোঘল ঘরাণার খাবার। শোনা যায় মুঘল সম্রাজ্ঞী মুমতাজ মহল মুঘল সৈন্যদের ব্যারাকে পরিদর্শনে যান। ব্যারাকে গিয়ে সৈন্যদের স্বাস্থ্য আর খাদ্য নিয়ে বেশ চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। মিলিটারির বাবুর্চিকে তিনি নির্দেশ দিলেন চাল আর মাংস সমৃদ্ধ এমন একটা পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে যেটায় সৈনিকদের ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হবে। সম্রাজ্ঞী মুমতাজ মহলের নির্দেশে যে খাবারটি প্রস্তুত হয় সেটাই আজকের দিনে বিরিয়ানি নামে পরিচিত।
মুঘলরা যেখানে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে সেখানেই সঙ্গে করে তাদের সংস্কৃতি, খাদ্য নিয়ে গেছে। এইভাবে বিরিয়ানি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। অঞ্চলভেদে সেখানকার খাদ্য বৈশিষ্ট্য সেই খাদ্যে প্রবেশ করেছে। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামের বিরিয়ানির কথা শোনা যায়।
বাংলাদেশ কাচ্চি বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত। পুরনো ঢাকায় কাচ্চি বিরিয়ানির প্রচুর চাহিদা। ঢাকা শহরেও বিরিয়ানির প্রবেশ ঘটে মুঘলদের হাত ধরেই। কাচ্চি বিরিয়ানির জন্ম মধ্য এশিয়ায়। তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তানে লাল মাংস জনপ্রিয় ছিল। লাল মাংস বলতে সেখানে মূলত খাসি বা ভেড়ার মাংস খেত। এই লাল মাংস দিয়েই শীতপ্রধান অঞ্চলগুলিতে কাচ্চির প্রচলন শুরু হয়।
তৈমুর শাসনের শেষদিকে যখন সমরখন্দের বাড়বাড়ন্ত তখনই সম্ভবত এই খাবারের প্রচলন বলে অনুমান করা হয়। ভারত উপমহাদেশে ১৬১০ সালে কাচ্চি বিরিয়ানির প্রচলন হয়। মুঘল সুবেদার এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা ঢাকায় প্রশাসন পরিচালনা করতে আসেন। তাঁরা সঙ্গে করে বিরিয়ানিও নিয়ে আসেন। ভারতের লখনউ থেকে আসা শাসকদের সঙ্গে নিজস্ব রাঁধুনিও আসে।
বিরিয়ানি শব্দটি ফার্সি শব্দ। ফার্সি "বিরিঞ্চি"(যার অর্থ ভাত) থেকে বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে। তবে অনেক ভাষা বিশেষজ্ঞের মতে বিরিয়ানি শব্দের জন্ম "বিরয়ান" বা "বোরিয়ান" (যার অর্থ ভাজা বা রোস্ট)।
আর কাচ্চি বিরিয়ানির "কাচ্চি" শব্দটা এসেছে উর্দু "কাচ্চা" শব্দটি থেকে। যার বাংলা অর্থ কাঁচা। যেহেতু সুগন্ধি চালের সঙ্গে মাংস সরাসরি রান্না করা হয় তাই এর নাম "কাচ্চি"। এটি হিন্দি ও উর্দুতেও একই নামে পরিচিত। সেদ্ধ ছাড়া মাংস টক দই দিয়ে মাখিয়ে তার উপর আলু আর চালের আস্তরণ দিয়ে রান্না করা হয়। অন্যদিকে সেদ্ধ বা পাক করা মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হয় পাক্কি বিরিয়ানি।
বিরিয়ানির দোকানগুলির পীঠস্থান হল ঢাকা। কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিমুদ্দিন রোড, উর্দু রোড, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, চকবাজার, রায়সাহেব বাজার, নবাবপুর, কোতোয়ালি, ইসলামপুর, মালিটোলা, মৌলবীবাজার ইত্যাদি জায়গায় বিরিয়ানির দোকান গড়ে উঠেছে।
বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হচ্ছে অর্থাৎ ১৯৩৯ সাল নাগাদ ঢাকায় প্রথম বিরিয়ানির দোকান গড়ে ওঠে। দোকানের মালিক ছিলেন হাজি মহম্মদ হোসেন। ঢাকা জুড়েই যা হাজির বিরিয়ানি নামে পরিচিত। পুরনো ঢাকায় কাজী আলাউদ্দিন রোডে হাজি মহম্মদ নাকি একটি মাত্র হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
হাজির বিরিয়ানির পাশাপাশি ফখরুদ্দিন মুন্সি বিরিয়ানির দোকান খোলেন। ১৯৬৬ সালে ভিকারুন্নেসা স্কুলের ক্যান্টিনের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয় ফখরুদ্দিন বিরিয়ানির। তারপর সময় মত গড়িয়েছে, ততই জনপ্রিয় হয়েছে এই বিরিয়ানি।
হাজি সিরাজ-উল-ইসলাম নান্না। অল্প বয়স থেকে কষ্টের জীবন। প্রথমে বিড়ি বাঁধতেন। এক খাবারের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেই ভাগ্য বদলে যায়। হয়ে উঠেন নান্না বিরিয়ানির জনক। মোরগ পোলাও দিয়ে যাত্রা শুরু। ১৯৬২ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে নান্নার মোরগ পোলাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর তারসঙ্গে জুড়ে যায় কাচ্চি বিরিয়ানি।