ত্রিপুরা। ভারতের পূর্বাঞ্চলের পুরাণ ও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ একটি বাংলাভাষী রাজ্য। এই রাজ্যের উদয়পুরে রয়েছে সুবিখ্যাত একটি সতীপীঠ। সেই পীঠে রয়েছে পাঁচশো বছরের প্রাচীন একটি মন্দির। মন্দিরটিকে ভক্তজন ভক্তিভরে ‘মাতাবাড়ি’ নামে ডেকে থাকেন। কেননা, মন্দিরে রয়েছে কালো কষ্টিপাথরে নির্মিত মাতা ত্রিপুরেশ্বরীর অপূর্ব দুই বিগ্রহ।
মন্দিরটি ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা ধনমাণিক্য নির্মাণ করেন। তিনিই দেবীর প্রতিষ্ঠাতা। মন্দিরটির সঙ্গে বৌদ্ধমন্দির বা প্যাগোডার ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। চূড়া এবং চার-চালায় সেই সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। ঐতিহাসিকেরা তাই অনুমান করেন যে, মন্দিরটি পূর্বে একটি প্রাচীন বৌদ্ধপ্যাগোডা ছিল, পরবর্তীকালে ধনমাণিক্য সেটি অধিকার করে তার কিছু কিছু সংস্কার করে তাকে হিন্দুমন্দিরে রূপান্তরিত করেন এবং দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
আবার মন্দিরটি যে আগাগোড়া এভাবে ধনমাণিক্যই তৈরি করিয়েছিলেন, তার সপক্ষে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ না-থাকলেও একটি জনশ্রুতি আছে। সেই জনশ্রুতিতে বলা হচ্ছে যে, রাজা তাঁর আরাধ্য দেবতা ভগবান বিষ্ণুর জন্য একটি মন্দির তৈরি করেন, তাঁকে প্রতিষ্ঠা করে ব্যাপক জাঁকজমকের সঙ্গে পূজা করবেন বলে। কিন্তু মন্দির সম্পূর্ণ হতেই একদিন দেবী স্বয়ং তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, বৎস, চট্টগ্রামের সদরঘাটে একটি গাছের নীচে আমি এখন পূজিত হচ্ছি; কিন্তু আর আমার এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না। তুমি তোমার নবনির্মিত মন্দিরে আমায় নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে পূজো কর।
দেবীর আদেশ অমান্য করার সাধ্য কার! সুতরাং, রাজাও সেই আদেশ অমান্য করার সাহস করলেন না। ভগবান বিষ্ণুর জন্য নির্মিত মন্দিরে দেবীকে গাছের তলা থেকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করলেন এবং মহাসমারোহে পূজা শুরু করলেন।
রাজা ধনমাণিক্যের দেবী-প্রতিষ্ঠার আর একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেও চট্টগ্রাম সম্পর্কিত। তাতে বলা হয়েছেঃ
চট্টগ্রামে হিন্দুকুশ পর্বতের পাদদেশে ছিল একটি গ্রাম। সেই গ্রামে বাস করত এক ধোপা। সেই ধোপার একটি গাভী ছিল। গ্রামের পাশে ছিল এক গহীন বন। কাপড় কাচার অবসরে ধোপা গাভীটিকে নিয়ে সেই বনে চরাতে যেত। চরাতে গিয়ে একদিন ধোপা এক কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল। একটি স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে গাভীটি অঝোর ধারায় পালান থেকে দুধ বর্ষণ করছে। বুঝল, স্তূপের মধ্যেই কোন রহস্য আছে। অমনি শুরু করল সেই স্তূপ খুঁড়তে। অনেক খোঁড়াখুঁড়ির পর মাটির নীচে সে খুঁজে পেল অদ্ভুত সুন্দর এক শিবলিঙ্গ। অদ্ভুত, কেন না শিবের পাশে রয়েছেন দেবী শক্তিও। চতুর্ভুজা করালবদনা মা কালী। শিব-শক্তির অদ্ভুত এই সম্মিলন দেখে ধোপা কৃতার্থ হয়ে গেল একেবারে। শুরু করল দেবীর পূজা। অচিরেই ঘটল দেবীর কৃপাময়ী রূপের প্রকাশ। দেবীর কৃপায় ধোপার কোন অভাব রইল না, অভিযোগ রইল না। তার ধনের আগার অন্নের আগার সব উপচে পড়তে লাগল। অমনি সেই কৃপার কথা ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। দশদিক থেকে নামতে শুরু করল ভক্তের ঢল। ক্রমে দেবীর মাহাত্ম্যের কথা উঠল ত্রিপুরার রাজা ধনমাণিক্যের কানেও।
শুধু তাই নয়, রাজা শুনলেন যে, এই শিবশক্তিকে পূজা করলে অতুল সম্পদ ও অনন্ত সৌভাগ্য লাভ করা যায়। ব্যস। রাজা অমনি নড়েচড়ে বসলেন। সম্পদ ও সৌভাগ্যে রাজাদের তো চিরকালের টান। অমনি সান্ত্রী-মন্ত্রী সক্কলকে নিয়ে রাজা পাড়ি দিলেন ধোপার তৈরি দেবস্থানে। রাজা বললেন, শিবশক্তি দুজনকেই তিনি নিয়ে গিয়ে রাজধানী ত্রিপুরায় প্রতিষ্ঠা করবেন। তাই তো তাই। রাজার ইচ্ছে, তাকে ঠেকায় কে! ধোপা বাধা দেওয়ার সাহস করল না। মনে মনে বলল, হে শম্ভু, আর যাই হোক অন্তত তুমি আমায় ছেড়ে যেও না গো!
ধোপার প্রার্থনায় অন্তরের আর্তি ছিল। সেই আর্তিতে সাড়া দিলেন শম্ভু। ওদিকে রাজার লোকেরা সুন্দর এক পালকি প্রস্তুত করল; মহাসমারোহে ঢাকঢোল, ঝাঁঝর-কাঁসর, শঙ্খ বাজিয়ে উলু দিয়ে শিবশক্তিকে নিয়ে যাবে বলে তৈরি হল। লেগে পড়ল শিবলিঙ্গটিকে মাটি থেকে তোলার কাজে। নাহ, তাঁকে এক চুলও নড়াতে পারল না। তাই বলে তারা মোটেই হতাশ হল না। লিঙ্গের চারপাশের মাটি খুঁড়তে শুরু করল। কিন্তু হাজার খোঁড়াখুঁড়ি করেও লিঙ্গের শেষ কিছুতেই খুঁজে পেল না। তখন রাজা হত্যে দিয়ে পড়লেন সেই শিবলিঙ্গের পাদভূমিতে। তখন শিব তাঁকে কৃপা করতে ইচ্ছে করলেন। শিবের কৃপায় রাজার চোখে তন্দ্রা এল। তন্দ্রার আবেশে রাজা শুনতে পেলেন শিবের কথা। শিব বলছেন, হে রাজন, তুমি বৃথা চেষ্টা করছ আমাকে উত্তোলনের। আমি এখানে স্বয়ম্ভূ, এখানে ধোপা আমার কৃপাপ্রার্থী। তাই এ স্থান ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। তুমি বরং দেবীকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। তাঁর কৃপা পেলেই তোমার মঙ্গল হবে। যা চাইবে, তাই পাবে। তবে দেবী তোমার ইচ্ছেমতো স্থানে যাবেন না, তাঁর অধিষ্ঠানস্থান তিনিই ঠিক করবেন। দেবীকে সঙ্গে নিয়ে রাত্তিরেই রওনা দাও। যেখানে ভোরের আলো ফুটবে, সেখানেই দেবী চিরদিনের জন্য অধিষ্ঠান করবেন। দেখ, দেবীর গন্তব্য কোথায় নির্দিষ্ট হয়!
মহাদেবের আদেশ শেষ হতেই রাজার তন্দ্রা দূর হল। পুরো ব্যাপারটা আত্মস্থ করে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল তাঁর। তিনি সচকিত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে দেখলেন যে রাত্রির প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। অমনি আর দেরি না-করে সকলকে আদেশ দিলেন দেবীকে সযতনে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর অভিমুখে রওনা হতে। পালকি, রথ, ঘোড়া, হাতি অমনি সদলে ছুটল সেদিকপানেই। ছুটতে ছুটতে সকলেই যখন উদয়পুরে পৌঁছলেন, তখন ভোরের আলো হঠাৎ ঝিলিক মেরে ফুটে উঠল। অমনি দেবী সেখানেই থেমে গেলেন। তাঁকে আর একচুলও নড়ানো গেল না। রাজধানী তখনও বেশ খানিকটা দূর। সে যাই হোক, শম্ভুর আদেশমতো দেবীর ইচ্ছেমতো উদয়পুরেই রাজা দেবীর মন্দির নির্মাণ করে তাঁকে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করলেন। ত্রিপুরারাজ্যের অধিশ্বরী দেবীর নাম রাখলেন, ‘ত্রিপুরেশ্বরী’।
এবার এই দুই জনশ্রুতি ও প্রেক্ষাপট বিচার করে মন্দির তৈরির ইতিহাস আসুন একটু উল্টেপাল্টে দেখিঃ
প্রথমত, মন্দিরটি কাছিমের পীঠের মতো একটি টিলার ওপর অবস্থিত। যাকে বলে ‘কূর্মপীঠ’। শাক্ত ও তন্ত্রমতে শক্তিমন্দির নির্মাণ এই রকম ভূমিতে করারই বিধান রয়েছে। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দিরটিও শাস্ত্রবিধি মেনে এমন কূর্ম-আকৃতির ভূমির উপরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রানি রাসমণি। তাই রাজা জনশ্রুতি অনুযায়ী, বিষ্ণুর জন্য মন্দির নির্মাণ করে তাতে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—এই সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। তাছাড়া বৌদ্ধধর্মেও শেষদিকে হিন্দুপ্রভাবিত তন্ত্রচর্চা খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তাই কূর্ম-আকৃতির ভূমিতে তন্ত্রদেবীর প্যাগোডা নির্মাণ করে বৌদ্ধরা এখানে তন্ত্রচর্চা করতেই পারেন। পরবর্তীকালে তাঁদের মন্দিরটি রাজা ধনমাণিক্য কর্তৃক অধিগৃহীত হয়ে মন্দিরে রূপান্তরের বিষয়টিও তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মোটকথা, জনশ্রুতি অনুযায়ী মন্দিরটি মোটেই ভগবান বিষ্ণুর জন্য তৈরি হয়নি।
দ্বিতীয়ত, মন্দিরের গর্ভগৃহের বেদিতে দেবীর দুটি কষ্টিপাথরের মূর্তি আছে। একটির উচ্চতা পাঁচ ফুট, অন্যটির উচ্চতা দুই ফুট। কম উচ্চতা বিশিষ্ট বিগ্রহকে সকলেই ‘ছোট মা’ বলে সম্বোধন করেন। দুই মূর্তিই অখণ্ড পাথরে নির্মিত। শিবের ওপর দণ্ডায়মানা চতুর্ভুজা কালী। বড় বিগ্রহের দুই ডান হাতে রয়েছে ‘অঙ্কুশ’ ও ‘বরাভয়’; দুই বাম হাতে রয়েছে ‘পাশ’ ও ‘মুণ্ড’। এই মূর্তিটি রাজার তৈরি। ‘ছোট মা’ কিন্তু অনেক প্রাচীন। তিনিই আদিমূর্তি। চট্টগ্রাম থেকে দেবীকে আনার যে জনশ্রুতি; তা সত্যি। এবং ইনিই হচ্ছেন সেই তিনি।
তৃতীয়ত, দেবীর এই পীঠটি আসলে অনেক প্রাচীন। রাজা ধনমাণিক্যের পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন নিশ্চয় কোন মন্দির ছিল না। মূর্তি ছিল না। কিন্তু পীঠটি ছিল। বলছি, তার কারণ, প্রাচীন তন্ত্রগ্রন্থ ‘পীঠনির্ণয়’-এ স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে—
‘ত্রিপুরায়াং দক্ষপাদো দেবী ত্রিপুরসুন্দরী
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বাভীষ্টপ্রদায়কঃ।’
অর্থাৎ, দেবী সতীর দক্ষিণ পদ বা ডান পা ত্রিপুরায় পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম, ‘ত্রিপুরসুন্দরী’; তাঁর ভৈরবের নাম, ‘ত্রিপুরেশ’। এ নামে ত্রিপুরায় এই একটিই পীঠ রয়েছে। এবং তা প্রাচীনকাল থেকেই ভক্তজনের মান্যতা পেয়ে এসেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই ত্রিপুরেশ ভৈরব অর্থাৎ ত্রিপুরেশ শিবলিঙ্গ দেবী মন্দিরের নিকটে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা ধনমাণিক্য। কিন্তু আসল ভৈরব কিংবদন্তি অনুযায়ী হিন্দুকুশের পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত, যাঁর সান্নিধ্য থেকে রাজা দেবীকে নিয়ে আসেন। সেই অনন্তলিঙ্গ শিব ‘চন্দ্রনাথ’ নামে আজও পূজিত হয়ে চলেছেন।
এবার আসি দেবীর কথায়। দেবী এখানে ষোড়শীরূপে পূজিতা হন। দশমহাবিদ্যার এক রূপ ‘ষোড়শী’। নিত্য তাঁর উদ্দেশ্যে ছাগবলি হয়। সুপ্রাচীনকালে এখানে নরবলি দেওয়ার ইতিহাসও রয়েছে। দেবীর নিত্যপুজো শুরু হয় ভোর চারটেয়। মঙ্গল আরতি ও ভোগনিবেদনের মধ্য দিয়ে। তারপর দেবীর স্নান ও শৃঙ্গার হয়। তারপর ছাগবলি দিয়ে শুরু হয় পুজো। বলি উৎসর্গ করা হয় দেবীর অনুচর ডাকিনী-যোগিনীদের উদ্দেশ্যে। মন্দিরের গায়েই রয়েছে সুবিশাল কল্যাণসাগর পুষ্করিণী। তাতে রয়েছে অসংখ্য মাছ ও বৃহদাকার কচ্ছপ। বলির মাংসের ভাগ তারাও পায়। দিবাভোগের পর দেবী বিশ্রাম নেন। বিশ্রাম শেষে সন্ধেবেলায় আরতি হয়। রাত্রে ভোগ নিবেদনের পর দেবীর নিদ্রার ব্যবস্থা করা হয়। এই হচ্ছে নিত্যসূচী। এই নিত্যপুজোয় অংশ নেওয়া ছাড়াও ভক্তজনেরা এখানে প্রতি বছর কার্তিকের শ্যামাপুজোর সময় ভিড় জমান। কেননা, এই সময় মহাসমারোহে দেবীর পুজো হয়। মন্দিরকে কেন্দ্র করে বসে বিরাট এক জমজমাট মেলা।...