দুর্গা পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ক্ষীরের মণ্ডা

মণ্ডা এক শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টি। উনিশ শতকের দুর্গা পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল এই মণ্ডা। ছানা তখনও ভিয়েনের ভিসা পায়নি। নিরেট ক্ষীরের মণ্ডাই ছিল দেব নৈবেদ্যর হার্টথ্রব। সেকালে বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারি পুজো সবেতেই মূল নৈবেদ্য বিশেষ ধরনের মণ্ডা। যা আগা তোলা মণ্ডা বা দুর্গা মণ্ডা নামে পরিচিত ছিল। আবার মণ্ডা বলিও দেওয়া হত দুগ্গার সামনে। অবাক হবেন না! কী কী যে বলি হত তার কল্পনা করা যাবে না। এমনকি গোলমরিচ, আদা গাছ অবধি বলি দেওয়া হত দেবীর সামনে!

যে যে বাড়িতে মণ্ডা বলি দেওয়া হয় তাদের কথা বলি। বর্ধমানের খাজা আনোয়ার বেড় এলাকার জমিদার ছিলেন ব্রজেন্দ্রলাল দাস। ব্রজেন্দ্রলাল ছিলেন অপুত্রক। কথিত আছে, ব্রজেন্দ্রলাল দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে দেবী দুর্গা তাঁকে শিবদুর্গার পুজো করতে বলেন। পুজো করলে পুত্র সন্তান লাভ হবে, তাও জানান। স্বপ্নাদেশ পেয়ে ব্রজেন্দ্রলাল শিবদুর্গার পুজো শুরু করেন। পরের বছরই জন্ম নেয় পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় দুর্গাচরণ। বাড়ির পুজোয় বলিদানের চল ছিল। পাঁঠা বলি হত। ব্রজেন্দ্রলাল স্বপ্নাদেশ পান বলি বন্ধ করার। সেই থেকে বলি প্রথা বন্ধ, শুরু হয় মণ্ডা বলি দেওয়া।

বাকতা গ্রামের দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয় মণ্ডা, মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে মণ্ডা বলি দেওয়া হয়।
বর্ধমানের খাজা আনোয়ার বেড় এলাকার এই দাসবাড়ির দুর্গাপুজোয় আবার সন্ধি পুজোর সময় এখনও নাকি দুর্গামণ্ডপের উপর শঙ্খচিল উড়তে দেখা যায়। দশমীর দিন দেবীর বিসর্জন হয় তখনও আকাশে ওড়ে শঙ্খচিল। ১৫০ বছর আগে এই পুজোর পুজোর প্রচলন করেছিলেন জমিদার মাখনলাল দাস। মাখনলাল দাসের সময়ে ঘটে পুজো হত, মূর্তি পুজো হত না। এখন দাসবাড়িতে মৃন্ময়ী মা আসেন। শিব-পার্বতীর দুপাশে বসেন দেবী লক্ষ্মী আর সরস্বতী । তাঁদের নিচে থাকে দেবসেনাপতি কার্তিক আর সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি। দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী নন, হরগৌরী।

হেতমপুর রাজবাড়ির পুজোতেও মণ্ডার বলির প্রথা আছে। রাজবাড়ির পুজোতে পশু বলি হয় না। বদলে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিন হয় মণ্ডা বলি। সপ্তমীর দিন এক কেজি ওজনের মণ্ডা, অষ্টমীর দিন দু’কেজি ওজনের মণ্ডা এবং নবমীর দিন এক কেজি ওজনের মণ্ডা বলি দেওয়া হয়। বিশেষ দোকান থেকে তৈরি করিয়ে আনা হয় মণ্ডা। রাজবাড়ির পুজোর বয়স দু'শো ছুঁইছুঁই।

বৌদ্ধ যুগে প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে স্বর উঠতে শুরু হয়। বাংলায় বৈষ্ণব যুগেও প্রাণী হত্যা কমতে থাকে। বলিদানে আঘাত আসে। ছাগ, মহিষ, মাছের বদলে অনুকল্প হিসাবে চাল কুমড়ো, আখ বলির রীতি শুরু হয়ে। সেইভাবেই বলিদানে এসে পড়ে দ্বি-শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টি মণ্ডা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...