মন্তেশ্বরের চামুণ্ডা মন্দির, বৈশাখের শুক্ল অষ্টমী থেকে চারদিন ধরে পূজিতা হন দেবী

চামুণ্ডা পুজোর চল খুব একটা বেশি দেখা যায় না। চামুণ্ডা মন্দিরও বেশ বিরল। দেবীকে কালীর রূপ হিসেবেই মনে করা হয়। আবার কোথাও কোথাও তিনি ভগবতী দুর্গা। পূর্ব-বর্ধমানের মন্তেশ্বরে রয়েছে  চামুণ্ডা মন্দির। মন্তেশ্বরের দেবী বিগ্রহ বিবসনা, ত্রিনয়না ও শ্যামবর্ণা। দেবী মূর্তির ডানহাতে ডমরু, শূল, অসি ও পানপাত্র এবং বাম হাতে ত্রিশূল দিয়ে তিনি চণ্ড ও মুন্ডকে বধ করছেন। দেবী বিগ্রহের গলায় নরমুণ্ডমালা। বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে এই মন্দিরের বিশেষ পুজো হয়। চামুণ্ডা পুজো উপলক্ষ্যে অকাল দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে মন্তেশ্বর। দুর্গাপুজোর মতোই চামুণ্ডা পুজো ৪ দিন ধরে চলে। মন্তেশ্বর গ্রামের মাইচপাড়ায় রয়েছে দেবী চামুণ্ডার মূল মন্দির। মন্দিরে বছরভর বিরাজ করেন তিনি। এছাড়াও দেবীর বড়মন্দির ও ভোগমন্দির নামে আরও দু্টি মন্দির রয়েছে।

অধিবাস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেবীর বাৎসরিক পুজো আরম্ভ হয়। গ্রামের হাজরা বাড়িতে দেবীর বিবাহ অনুষ্ঠানের পর দেবীকে মূল মন্দির থেকে স্থানীয় খাঁ পুকুরের জলে রাতেরবেলা ডুবিয়ে রেখে আসা হয়। রাতভর জলেই থাকেন দেবী। পরদিন সকালে বাগদি সম্প্রদায়ের লোকজন পুকুরের জল থেকে খুঁজে তুলে আনেন দেবীমূর্তি। তার পরে গ্রাম পরিক্রমা করার পরে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দিরে। তারপরই এলাকার সবচেয়ে বড় উৎসব- চামুণ্ডা পুজোয় মেতে ওঠেন মন্তেশ্বরের বাসিন্দারা। পাঁচ দিনের এই পুজো ঘিরে বসে জমজমাট মেলাও। অষ্টমী তিথিতে দেবীর গায়ে হলুদ হয়। এই অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে দেবীর খোঁজে খাঁ পুকুরের জলে নামেন ভক্তরা। জল থেকে তুলে দেবীকে একবার কোলে নেওয়ার জন্য ভক্তদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। জল থেকে তোলার পর পুকুরপাড় থেকে পুজো ও বলিদান পর্ব শুরু হয়ে যায়। মূল মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার আগে দেবীকে চতুর্দোলায় তুলে কাঁধে চাপিয়ে উদ্দাম নৃত্য করেন ভক্তের দল। ওই রাতেই বড়মন্দিরে দেবী পৌঁছনোর পর মহিষ ও ছাগবলি হয়। নবমীতে দেবীকে ভক্তরা কাঁধে করে চতুর্দোলায় চাপিয়ে বিভিন্ন বেদিতে যান ও পুজো দেন। দশমী তিথিতে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে উপচে পড়ে পুজোপ্রাঙ্গণ। বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচন্দ মহতাব দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দেন। পুজোর জন্য অর্থবরাদ্দের পাশাপাশি তিনি জমিও দান করেন।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, দেবী মূর্তির বয়স প্রায় ৯০০ বছরেরও বেশি। কষ্টি পাথর নির্মিত চামুণ্ডা মূর্তির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দেবীর গলায় রয়েছে মুণ্ডমালা। তাঁর এক হাতে রয়েছে পানপাত্র। পায়ের নীচে রয়েছে ডাকিনী যোগিনী। প্রাচীন জনশ্রুতি অনুসারে, এলাকার এক ব্রাহ্মণ স্বপ্নাদেশ পেয়ে জেলেদের সাহায্যে খড়ি নদী থেকে মূর্তিটি পেয়েছিলেন। তিনিই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পুজোর প্রচলন করেছিলেন। প্রতি বছর বৈশাখের শুক্ল অষ্টমীর দিন পুজো শুরু হলেও, প্রকৃতপক্ষে পুজোর সূচনা হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে। ওই দিন থেকে শুরু হয় ময়ূর নাচ। পুজোর মূল আকর্ষণ হল পুজোর আগের রাত থেকে শুরু হওয়া রেওয়াজ। মূল পুজোর আগের দিন রীতি মেনে লাঙল টানার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যে দুটি বলদ লাঙল টানে, তাদের সঙ্গে মা চামুণ্ডার বিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে মাঝ রাতে দেবীকে খাঁ পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। মূর্তি জল থেকে তোলার দায়িত্বে থাকেন বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষজন। তাঁরাই রাতভর দেবী মূর্তি পাহারা দেন। পরদিন দুপুরে শুরু হয় পুকুরের জলে মূর্তি খোঁজার পালা। সেই মূর্তি খুঁজে পাওয়ার পরে শুরু হয়, কে আগে মূর্তি নিয়ে পুকুর পাড়ে উঠবে তার প্রতিযোগিতা। মূর্তি জল থেকে না তোলা পর্যন্ত গ্রামের প্রত্যেকের বাড়িতেই অরন্ধন পালিত হয়। এরপর শুরু হয় গ্রাম পরিক্রমা। রাতের বেলা দেবীকে মন্দিরে নিয়ে আসার পরে শুরু হয় মূল পুজো। মন্তেশ্বরের গ্রাম দেবী হলেন দেবী চামুণ্ডা। পুজো উপলক্ষ্যে প্রত্যেকের বাড়িতেই আত্মীয় সমাগম হয়। বাইরে থেকেও প্রচুর মানুষ আসেন, মেলা বসে, নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

এই গ্রামের বনেদি পরিবার চৌধুরি বাড়িতে দুর্গা পুজো হয়। মন্তেশ্বরের চৌধুরি বাড়িতে পুজো হয় নবপত্রিকায়। বাড়ির পাশেই দেবী দুর্গার আরেক রূপ দেবী চামুণ্ডা আছেন। সেজন্যই মন্তেশ্বরের চৌধুরী বাড়ির কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই পুজোয় মাটির প্রতিমা আনা হয় না। দেবী চামুণ্ডা যেহেতু দেবী দুর্গারই আরেক রূপ তাই চৌধুরী বাড়িতে কোনও মৃন্ময়ী মূর্তি আনা হয় না। দুর্গাপুজোয় দেবী চামুণ্ডার ঘট আনার সময় চৌধুরী বাড়ির সদস্যরাও মঙ্গল ঘট আনেন। ষষ্ঠীর দিন সকালে অধিবাস ও সন্ধ্যায় বেলতলায় ষষ্ঠীকল্পের মধ্য দিয়ে পুজো শুরু হয়। সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নান পর্বের পরেই নবপত্রিকা ও মঙ্গলঘট এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজো হয়। নবমীর দিন সন্ধ্যায় দেবী চামুণ্ডার মন্দিরে পুজো নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন রাতে সেখানেই পুজো হয়। এখানে কুমারী পুজো হয়। দশমীর দিন কুমারীকে মণ্ডপে নিয়ে এসে দেবীর সামনে পুজো করা হয়। রীতি মেনে পরিবারের মঙ্গলের প্রতীক হিসাবে শঙ্খচিল যাত্রা নামের একটি অনুষ্ঠান হয়। আকাশে শঙ্খচিলের দেখা পেলে শুরু হয় বিসর্জনের প্রস্ততি।

আবার পৌষ মাসে চামুণ্ডা মন্দিরে বিশেষ উৎসব হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিনেই দেবী চামুণ্ডাকে কেন্দ্র করে মন্তেশ্বরের মাইচপাড়ায় উগল-উ উৎসব হয়। এই উৎসবে মেতে ওঠেন মন্তেশ্বরবাসী।পৌষ সংক্রান্তির দিন দেবী চামুণ্ডাকে মূলমন্দির থেকে ভোগমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেবীকে নিয়ে ঢাকবাদ্যিসহ নাচতে নাচতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে ভোগ মন্দিরে যান সকলে। তারপর চণ্ডীপাঠ হয়, দেবীর পুজো হয়। মেলাও বসে। পৌষ সংক্রান্তির দিন দেবীর ভোগমন্দিরে আসা, এবং সেই উপলক্ষ্যে পুজোকে উগল-উ পুজো বলে। পৌষ মাস বাংলার লক্ষ্মী মাস, সেই মাসে যাতে গৃহস্থের শস্য, সম্পদ ধনসম্পদ উপচে ওঠে সেই কারণে এই পুজো হয়। ভক্তদের বিশ্বাস দেবী সকলের মনোষ্কামনা পূরণ করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...