বিবি রাসেলের হাত ধরেই আজ বিশ্বের দরবারে বাংলার গামছার বিবিয়ানি

ইয়া বড় একটা টিপ। নাকে রূপোলি নোলক। কানের দুলও ঠিক আর পাঁচটা দুলের মত তেমন পরিচিত গয়না নয়। তবে চোখে দৃঢ়তার ছাপ সুস্পষ্ট। এই চোখ তাঁর নিজস্ব দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবী দেখে, এই চোখ স্বপ্ন দেখতে জানে এবং দেখাতে জানে। তিনি বিবি রাসেল। 

বাংলাদেশের এই ফ্যাশন-দূতের হাত ধরে সামগ্রিক অর্থনীতিতে উন্নয়ন এসেছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশে বিবি রাসেলের কাজ দৃষ্টান্ত। বিবি রাসেলের জন্ম চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান এবং মা শামসুন নাহার। পাঁচজন সন্তানের মধ্যে বিবি তৃতীয়। কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পড়াশোনা করেছেন বিবি। এরপর ঢাকার আজিমপুরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে পড়াশোনা শেষ করেছিলেন। প্রথাগত পড়াশোনার প্রতি বিবির আগ্রহ তেমন ছিল না, ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন অর্থাৎ সাজ-পোশাক তাঁকে টানত। বিশেষ কিছু ফ্যাশন বিশেষ স্তরের মানুষের জন্যই হবে এমনটা তিনি মনে করেন না। বাবা-মা যে জামা-কাপড় বিবিকে কিনে দিতেন তা কিছুতেই পছন্দ হতো না ছোট্ট বিবির। 

4b9ef42b00fe6fc443d5211f797ac9dd

মেয়ের মন ভালো করতে বাবা একবার একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিলেন বিবিকে, ছোটবেলা থেকে সেই সেলাই মেশিনে নিজেই নিজের জামা-কাপড় সেলাই করতেন বিবি। নিজের সাদা জামায় হলুদের দাগ দিয়ে নতুন নতুন ডিজাইন তৈরি করতেন বাড়িতেই। এই আগ্রহ আর পারিবারিক সমর্থনকে সম্বল করেই বিবি রাসেল পাড়ি দিয়েছিলেন লন্ডনে, ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে। 

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে উন্নতি হয়েছে ২০০০ সালের পর থেকে। শুধুমাত্র পোশাক তৈরি নয়, পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রেও বিবি রাসেলের অবদান দৃষ্টান্ত। লন্ডনের কলেজ অফ ফ্যাশন ডিজাইনিং থেকে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। পশ্চিমের বিভিন্ন ম্যাগাজিনের টপ মডেল ছিলেন।

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন নামকরা বিদেশি ডিজাইনার হাউস এবং ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন, তবে সেই বছরই তিনি বাংলাদেশে এসে নিজের নামে একটি প্রোডাকশন হাউস শুরু করেন। এই হাউসের মূল লক্ষ্য ছিল একেবারে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। দশ বছরের মধ্যে তিনি প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার গ্রামীণ পোশাক শিল্পীকে নিজের কাজের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন।

বিবি রাসেলের তৈরি করা ডিজাইন এখন সারা বিশ্বে প্রচলিত ও পরিচিত। মাত্র ১৬ বছর বয়সে একদিন তার বাবা ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইনার কোকো শ‌আনেলের করা একটি ম্যাগাজিন নিয়ে আসেন যেটা দেখেই প্রথমবার তাঁর ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছের কথা তিনি বাবাকে জানিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি লন্ডন কলেজ অফ ফ্যাশন ডিজাইনিং-এ প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে যোগ দিতে যান। এই যাত্রাপথ কিন্তু খুব একটা সহজ ছিল না, লন্ডনে গিয়ে অনেক সময়ই তাকে আর্থিক অসুবিধে পড়তে হয়েছে  , অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য চিঠি বিলির কাজও করেছেন তিনি। কিন্তু বাড়ির লোককে এমন অনটনের কথা জানতে দেননি। তিনি মন দিয়ে পড়াশোনা করে গেছেন এবং নিজের পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ করেছেন। 

তার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার বলিষ্ঠ ভাবনা অল্পদিনের মধ্যেই তাকে একটি পরিচিত মুখ গড়ে তোলে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মিশ্রণে তিনি সেই সময় বেশ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাজ করেছিলেন। নিজেকে আবিষ্কার করতে তিনি বরাবর ভালোবাসেন। ‌একটি শ্যামপুর মডেলিং-এর জন্য সুইমিংপুলে উঁচু জাম্প বোর্ড থেকে তিনি লাফ দিয়েছিলেন, যার জন্য টানা ১০ দিন অনুশীলন করেছেন। ফ্যাশন দুনিয়ায় বিবি রাসেল এক পরী যিনি অজস্র মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং গ্রামীণ অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিজের কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে আজ ও অনুপ্রাণিত করে চলেছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...