সন ১৯১৬। গোটা কলকাতা মুখর হয়ে আছে প্রেসিডেন্সি কান্ডে। কী ব্যাপার?
এক বাঙালি ছাত্রকে ঘিরে তুলকালাম ব্রিটিশ প্রশাসনিক মহলে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যলয়ের ছবিটি আরও রাগী রাগী। কলেজের বারান্দা থেকে ঘটনার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল বাঙালি বাড়ির অন্দর মহলেও। পরিষ্কার দু’ভাগে বিভক্ত তারা। তবে মেনে নিয়েছিল তেজ আছে বটে সেই বাঙালি ছাত্রের!
ঘটনার সূত্রপাত প্রেসিডেন্সি কলেজের বার্ষিক উৎসবে। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতি হয়েছেন ইতিহাসের অধ্যাপক এডোয়ার্ড এফ ওটেন। কয়েকজন ছাত্র মিলে শুরু করল উদ্বোধন সংগীত। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার দেশ’। গান শুরু হতেই বদলে যেতে শুরু করল সাহেবের মুখের ছবি। প্রচন্ড রাগে গরগর করতে থাকলেন। তাঁর সেই পরিবর্তন চোখে পড়ল উপস্থিত ছাত্রদের।
এক সময় গান শেষ হল। বক্তব্য রাখতে উঠলেন ওটেন সাহেব। কথা শুরু করেই ফেটে পড়লেন রাগে। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে সরাসরি বললেন, "ইউ বেঙ্গলিজ আর বার্বেরিয়ানস।"
অধ্যাপকের এমন অপমানে দল বেঁধে সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ছাত্ররা। সেই দলের নেতৃত্বে কলেজের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্র। সুভাষচন্দ্র বসু। সহপাঠী বন্ধুদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “ওটেন সাহেব শুধু ছাত্রদের নয়, গোটা বাঙালি জাতকে অপমান করেছে। এই ঘটনার বদলা নিতেই হবে...”
সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনায় পরদিন থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে শুরু হল পিকেটিং। কোনও ছাত্র ক্লাসে যাবে না। গেট থেকেই ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন অন্য ছাত্ররা। তাদের দাবী দুর্বিনীত ওটেন সাহেবকে ক্ষমা চাইতে হবে ছাত্রদের কাছে।
চূড়ান্ত চলাবস্থার জেরে টনক নড়ল কলেজ কর্তৃপক্ষের। কলেজের তদানীন্তন প্রিন্সিপাল এইচআর জেমস ডেকে পাঠালেন ছাত্রদের নেতাকে। সুভাষ গিয়ে দেখেন ওটেন সেখানে উপস্থিত।
প্রিন্সিপাল পূর্ব দিনের ঘটনাটি শুনেছিলেন। তিনি বুঝে ছিলেন যে অধ্যাপকপদে আসীন ওটেন সাহেব কখনও ভারতীয় ছাত্রদের প্রতি এম বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য করতে পারেন না। তিনি ওটেনকে এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন ছাত্রদের কাছে। কিন্তু উদ্ধত ওটেন ক্ষমা প্রার্থনা করলেন না, তিনি শুধুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করলেন।
ক্লাসে ফিরল ছাত্ররা। সবাই ভেবেছিল ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু সেটি হল না। ওটেন দুঃখ প্রকাশ করলেও রাগ থেকেই গিয়েছিল। ওটেন শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন সেই রাগ উপরে দেওয়ার। একদিন সামান্য এক অজুহাতে এক ছাত্রকে কলেজের করিডরে ফেলে বেধড়ক মারলেন।
সহপাঠীর এই অপমান এবারও মেনে নিল না ছাত্ররা। তারা কলেজের প্রধান সিঁড়িতে ঘিরে ধরে ওটেনকে। ধাক্কাধাক্কিতে আহত হন ওটেন। ঘটনার দায়ে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হল সুভাষচন্দ্রকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিষিদ্ধ হলেন তিনি। সুভাষচন্দ্র তখন সবে উনিশ!
পরে ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন সুভাষ। বি. এ. পরীক্ষায় সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে পাশ করেন।
এইসমস্ত ঘটনার মাঝেই আরও এক বিশেষ ঘটনা ঘটে যায় সুভাষচন্দ্রের জীবনে। ঘটনা ১৯১৬ সালেরই। একদিন রাত্রিবেলা সবে নৈশাহারে বসেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন।সামনে তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। হঠাৎই খাস ভৃত্য এসে খব দিল একদল ছাত্র এসেছে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বিশেষ দরকার। আদালতে তখন চিত্তরঞ্জন দাশ এক বাঘের মতো নাম। কোর্টরুমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বিপ্লবীদের জন্য বুখ চিতিয়ে। হয়ে উঠেছেন মানুষের ভরসার স্থল। তাই ছাত্ররা এসেছে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে সেই দলে সুভাষচন্দ্রও ছিলেন।
ছাত্রদের ফেরালেন না দেশবন্ধু। দেখা করলেন তাদের সঙ্গে। আলাপ হল সুভাষের সঙ্গে। তখনও দুজনের কারুরই জানা নেই তাঁরা একে অপরের কতটা কাছের হয়ে উঠবেন। শুধু চিত্তরঞ্জন না, তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীরও অত্যন্ত কাছের ছিলেন সুভাষচন্দ্র। দুজনের কাছেই পেয়েছিলেন অপর্যাপ্ত অপত্য স্নেহ। সেই সবই রসদ জুগিয়েছিল কৃতিছাত্র সুভাষচন্দ্রকে মানুষের ‘নেতাজী’ হয়ে উঠতে।
সুভাষচন্দ্র নিজেকে নিবেদন করতে চেয়েছিলেন দেশের সেবায়। ইংল্যান্ড থেকে তার এসেছিল চিত্তরঞ্জনের কাছে। সুভাষচন্দ্র তাঁকে লিখেছিলেন, “বঙ্গে ন্যাশনাল সার্ভিস প্রোগ্রামের প্রচারক আপনি। সেই জন্য, সামান্য যেটুকু শিক্ষা, মেধা, শক্তি এবং উৎসাহ আমার আছে তা নিয়েই আমি আপনার কাছে এসেছি...”
একবার ভেবে দেখুন এই পত্র যিনি লিখছেন তিনি ১৯২১-এ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের থেকে পদত্যাগ করে বঙ্গ তো বটেই, দেশেও হইচই ফেলে দিয়েছেন তখন।
কলকাতায় ফেরার পর চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে আবার দেখা করতে গেলেন সুভাষচন্দ্র। এও যেন এক সন্ধিক্ষণ। বাড়িতে দেশবন্ধু ছিলেন না। আইসিএস থেকে পদত্যাগ করা সুভাষচন্দ্র বাড়িতে এসেছে শুনে দেখা করতে এলেন বাসন্তী দেবী। অদ্ভুত এক মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল তাঁদের সম্পর্ক। বাস্নতী দেবীকে ‘মা’ ডাকতেন সুভাষ। সুভাষচন্দ্রের জন্মদাত্রী প্রভাবতী দেবী একবার বাসন্তী দেবীকে বলেছিলেন, “তুমিই সুভাষের মা, আমি তো কেবল ধাত্রী”।
বাসন্তী দেবীর সঙ্গে সুভাষের সম্পর্ক ছিল জলের মতো সহজ। ভাতেভাত ভাত খেতে ভালোবাসতেন সুভাষচন্দ্র। তাঁর জন্য রান্না করতেন বাসন্তী দেবী।
১৯২৫ সালের জুন মাসে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে ছিল বেশ জোরালো ধাক্কা। গুরু বিয়োগের সামিল। তিনি আরও বেশি করে দেশসেবার ব্রত এবং সংগঠনের কাজে নিজেকে সঁপে দেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে অন্তরালে চলে যেতে চাওয়া বাসন্তী দেবীকেও ফিরিয়ে আনেন রাজনৈতিক জীবনে।
১৯৩৩ সালে জব্বলপুর জেলে বন্দী ছিলেন নেতাজী। সেই সময় বাসন্তী দেবী দেখা করতে যান নেতাজীর সঙ্গে। প্রয়াত স্বামীর শাল পুত্রসম সুভাষকে উপহার দিয়ে বলেছিলেন, “ এই শালের সঙ্গে দেশবন্ধুর আশীর্বাদ আছে...”