দেবতার স্থান দেওরিয়া তাল

আমি আমার কর্তা দুজনেই পাহাড়প্রেমী। আমি পাহাড়ে জন্মেছি আর উনি শখে পর্বতারোহী। এরপর শৃঙ্গ জয়ের নেশা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। তবে মাঝপথে চাকরি হয়ে যাওয়ায় ওই শখকে দূরেই সরিয়ে রাখতে হয়। এরপর বিয়ে। বিয়ের পর থেকে বেশিরভাগ পাহাড়েই গেছি। ছেলে হওয়ার পাঁচ বছর পর অব্দি মোটামোটি খুব একটা উত্তঙ্গু পাহাড়ের দিকে যাওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে আমি শেষ অব্দি বেঁকে বসলাম যে আর শুধু হরিদ্বার, ঋষিকেশ, পুরী, দার্জিলিং যাবোনা। আমি ঋষিকেশের থেকে আরও উপরে যেতে চাই। ছেলেও বড় তখন। তাই সেবার একটা বিরাট প্ল্যানিং করা হল।


কয়েকদিন বসে মোটামোটি সব ছক কষে ফেলা হল। যাব আমরা তিনজন। আর আমরা কোনওদিন ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যাইনি। সব কর্তা ঠিক করেন। শেষ অবধি তিনি সেবারের ট্যুর পুরো সাজিয়ে ফেললেন।

কলকাতা থেকে দিল্লি বা হরিদ্বার যেমন টিকিট পাওয়া যায়। হরিদ্বার থেকে জোশিমঠ, জোশীমঠ থেকে বদ্রিনারায়ণ। মোটামোটি দুদিন একদিন দুদিন এভাবে সাজানো হলো। তারপর আবার ব্রেক করে করে ফেরা। ফেরাটা বদ্রি নারায়ণ থেকে উখিমঠ, উখিমঠ থেকে তুঙ্গনাথ, আবার উখিমঠ, তারপর সেখান থেকে সারি গ্রাম গিয়ে দেওরিয়া তাল দেখে আবার ফিরে আসা।

 

DeoriaTal1

 

পুজোর সময় যাওয়া। টিকিট হোটেল সব ব্যবস্থা করে দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। দিল্লি থেকে হরিদ্বার। সেখানে গিয়ে একটা গাড়ি ঠিক করে ফেলা হল। তারপর যেমন টা ঠিক করেছিলাম ঠিক সেভাবেই পৌঁছে গেলাম বদ্রিনারায়ণ।

আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বসুধারা ঝর্ণা পায়ে হেঁটে যাব। অবশ্য পায়ে না হাঁটলে মাথায় ঝুড়িতে করে নিয়ে যায়, তাতে যেতে হত আর ঝুড়িতে যায় সাধারণত বয়স্ক মানুষেরা। আমরা পায়ে হেঁটেই গিয়েছিলাম। সেই প্রাণান্তকর জার্নির গল্প আর একদিন হবে। মোদ্দা কথা হল, ওই অ্যাডভেঞ্চার। আমার অন্তত পায়ে হেঁটে পাহাড় ভ্রমণের শখ মিটিয়ে দিয়েছিল। বসুধারা থেকে ফিরে আমি আর ছেলে ধুম জ্বরে পড়লাম। ওষুধ ছিল। ক্রোসিন খেয়ে এক ঘুমে রাত কাবার!

 

ভোরে উঠে দেখি শরীর একদম ঝরঝরে। সেদিন ওখান থেকে ফিরে আমরা উখিমঠে নেমে আসি। উখিমঠ থেকে তুঙ্গনাথ যাওয়া যায় কিন্তু শারীরিক কারণে পদব্রজে আবার চড়াই উৎরানোর সাহস করতে পারিনি। উখিমঠে থেকে ঠিক করলাম সারি গ্রাম ঘুরেই আসি। সম্ভব হলে দেওরিয়া তাল চলে যাব।


যেমন ভাবা তেমনি কাজ। উখিমঠ বাবা কেদার নাথের শীতকালীন আবাস স্থল, পুণ্যধাম। অনেক কিছুই দেখার আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল পাহাড় মানে চলা ফেরায় যতটা স্থান আমরা পরিভ্রমণ করি পুরোটাই স্পট। আলাদা করে কোনো দর্শনীয় স্পটে না গেলেও চলে। গাড়ি আমাদের সঙ্গে। তাই জলখাবার খেয়ে ভারত সেবাশ্রম সংঘের বরাদ্দ ঘর ছেড়ে আমরা সাত কিলোমিটার দূরে সারি গ্রামের পথে রওনা দিলাম।

 

DeoriaTal2

 

সারি গ্রামে তখন দেওরিয়াতালের দর্শনার্থীদের গাইড হিসেবে ছিলেন লখপত সিং নেগিজি। সারি গ্রামের তার বাড়িটিই ছিল ট্যুরিস্টদের থাকার জায়গা। তাছাড়া দেওরিয়া তালের পাশে তাঁবুর ব্যবস্থাও তিনিই করতেন। আমরা তিনমাস আগে থেকেই তাঁবুতে থাকার আর্জি জানিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাই ওখানে গিয়ে তাঁবুতে থাকব মোটামোটি এটাই স্থির করা ছিল।


 গাড়ি উখিমঠ ছেড়ে সারি গ্রামের পথে রওয়ানা দিল। গাড়ি ঘন সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেই রাস্তায় এগিয়ে চলল। পথে দীর্ঘকায় গাছের সারি, একদিকে দূরে উত্তুঙ্গু বরফ সাদা শৃঙ্গ, কোথাও দূরে সবুজাভ পাহাড়, আর একদিকে অতলান্ত গিরিখাতকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললাম। নাম না জানা পাখি, গাছ আর রংবেরঙের ফুল সব নিয়ে আমাদের মনও তখন পরিযায়ী। দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম অভিজাত্যহীন সাদামাটা সবুজ গাছে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম সারি গ্রামে। থাকার ব্যবস্থা লখপত সিংজির ডেরায় তাই অকুস্থলেও পৌঁছে গেলাম। সেখানে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘর পেতে পেতে সন্ধ্যে। তখন পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরে আসছে সূর্যদেব অস্তাচলে, আর ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম অন্ধকারের চাদরে মুখ লুকোচ্ছে। গাছের পাতায় পাতায় ফিসফাস, কেমন নিঝুম শব্দহীন একটা গ্রামে আমরা কজন। রাতের খাওয়া ওরা ঘরেই দিয়ে গেল। যদিও তাবুতে থাকার কথা ছিল তবু আমরা আবার সাহসের অভাব বোধ করে নেগিজির ডেরায় থাকাই স্থির করলাম। মূলত দুটো কারণে আমাদের আগের প্ল্যান পরিত্যক্ত হল।

 

এক, সেদিন তাঁবুতে থাকার মতো পরিব্রাজকের অভাব, শুধুমাত্র আমরাই ছিলাম, আর দুই প্রচুর বন্য জন্তুর আধিক্য। ছোট বাচ্চা নিয়ে অতিরিক্ত সাহস মনে সঞ্চয় করতে পারিনি। ‘নেগিজির’ ডেরা বলতে সাদামাটা ঘর, বাসের আসবাব এইটুকুই। রাতে ভাল্লুকের উৎপাত গাড়োয়ালে থাকেই তাই পলকা বাঁশের আসবাবই দরজায় চাপা দিয়ে কোনরকমে রাত কাটিয়ে ফেলার চেষ্টা ছিল।

 

ভোরবেলা আসবে  ঘোড়া নিয়ে স্থানীয় একটি ছেলে। নিশুতি রাতে ভাল্লুকের ভয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আমরা। থেকে থেকে লোমশ কুকুরের ডাক যারা ভাল্লুক, বা চিতার (স্থানীয় ভাষায় তেন্দুয়া) খাদ্য। কুকুর পোষা হয় মানুষের আত্মরক্ষার জন্য। গাড়োয়াল এ এরকম লোমশ কুকুর বেশিরভাগ জায়গায় দেখেছি।

ভোর তিনটে নাগাদ অ্যালার্মের শব্দে আমরা ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে নিকষ কালো আঁধারের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম দেওরিয়া তালের উদ্দেশ্যে। একটুখানি এগিয়ে তোরণ। ভাঙা কাঠেরই হবে, ঠিক মনে নেই। তোরণ পেরিয়ে আমরা ঘোড়ার পিঠে সওয়ারী হলাম। ক্রমশ শুরু হল চড়াই পথ অতিক্রম করা। ঘোড়ার একটা স্বভাব হল তারা কেবলই খাদের ধার ঘেঁষে এগিয়ে চলে। আমরা ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচের অতলস্পর্শী খাদ দেখতে পাচ্ছি আর ভয়ে ঈশ্বরের নাম জপ করছি। ঘোড়া যত এগিয়ে চলেছে আর একের পর এক চড়াই অতিক্রম করে আরো চড়াই এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তত ভয় বাড়ছে। কারণ খাদ ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়ে চলেছে। পড়লে রক্ষা নেই জানি আর ঘোড়া আমাদের মনের অবস্থা বোধকরি বুঝতে পারছে না। তার আগ্রহ খাদের দিকেই। একেই বলে বোধহয় ন যযৌ ন স্ততৌ অবস্থা। এগোতেও ভয় পেছলেও ভয়।

DeoriaTal3

ঘোড়া যে কী করবে তার মতিগতি বোঝা ভার। এরকম চড়াই পেরোতে পেরোতে হৃদপিন্ড হাতে নিয়ে অবশেষে আমাদের অভিপ্সিত দেওরিয়া তালে এসে পৌঁছলাম। তখন সূর্যদেব তার কিরণ বিকিরণ করতে ব্যস্ত। ঘড়িতে হয়ত ছটা সাড়ে ছটা হবে।

ঘন সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ি পথে এগিয়ে দেখলাম বিখ্যাত দেওরিয়া তাল। সামনে সবুজ ঢেউ খেলানো উপত্যকা আর মাঝখানে টলটলে পান্না সবুজ জলে পরিপূর্ণ দেওরিয়া তাল। দেওরিয়া তাল অর্থ হলো ‘দেবতাদের স্নানের স্থল’। দেওতারা এই তালের জলে স্নান করতেন তাই এরকম নামকরণ। হিমালয়ের নৈসর্গিক দৃশ্য আগের ভয় কে কখন দূর করেছে জানিনা। সম্পূর্ণ উপত্যকা সবুজ গালচে দিয়ে মোড়া। দূরে হিমশীতল বরফের মুকুট পরে বিখ্যাত শৃঙ্গরাজি। নামজাদা শৃঙ্গরা হলো ভাগীরথী, ত্রিশূল, চৌখাম্বা, কেদারনাথ আরও কিছু শৃঙ্গ যাদের নাম মনে নেই।

 

এই জায়গার অপরূপ বৈশিষ্ট্য হল এই তালের জলে বরফের মুকুট পরা অথবা সূর্যালোকে সোনার তাজ পরিহিত শৃঙ্গের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়। হাজার হাজার ভ্রমণার্থী এই দুর্গম পথ পরিক্রমা করে দেওরিয়া তালের এই প্রতিবিম্ব দেখার জন্য ভিড় জমান। আমরাও তাদেরই দলের। অপরূপ দৃশ্য দেখে যেন আশ মেটে না। তবে এখানেই এই নৈসর্গিক দৃশ্যের স্বাক্ষী হতে হলে আসতে হবে খুব ভোরে অথবা তালের তীরে রাত্রি যাপন করতে হবে। সবুজ গালিচায় বসে বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকন করতে করতে একটু জল খাবারও খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। স্বল্পদূরে স্থানীয়দের এক আধটা দোকান আছে যেখানে চা, বিস্কিট এমন কী ম্যাগি, অমলেট পাওয়া যায়। তবে যত বেলা হতে থাকে একের পর এক শৃঙ্গ মেঘের আড়ালে চলে যায়।

 

তাই দেরি হলে অপরূপ প্রতিবিম্ব দর্শন থেকে যে বঞ্চিত হতে হবে তা বলাই বাহুল্য। শৃঙ্গ যত মেঘের আড়ালে চলে যায় ততই আর ওখানে থাকার কারণ থাকে না তাই একটু বেলা হলে নেমে পড়া যায়। আমরাও তাই ঘন্টা দুয়েক পর নেমে পড়লাম। তবে এবার আর ঘোটকের পৃষ্ঠে আরোহণ না করে পদব্রজেই নেমে এলাম। পাহাড়ে উৎরাই তত কঠিন নয় তবে সাবধানতা অবলম্বন করতেই হয়। আমরা শহুরে তাই পাহাড়ের মাটির সঙ্গে কতটুকু পরিচিত। আর বিপদ তো বলে কয়ে আসে না। ঘন্টাখানেকের মধ্যে নেমে আমরা নেগিজির ডেরায় এসে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম হরিদ্বারের উদ্দেশে। পাহাড়, জঙ্গল উপত্যকা, নদী গাছ গাছালি, পাখি আর রং বেরঙের ফুল প্রজাপতিকে মনের গোপন কুঠুরিতে বন্দি করে আবার শহুরে জীবনে ফেরার প্রয়াস। পিছনে পড়ে রইল সবুজ গালচে মোড়া পান্না সবুজ দেওরিয়া তাল আর গলানো সোনার তাজ পরিহিত শৃঙ্গের অতল আহব্বান। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষের কানে সে আহব্বান কবে পৌঁছাবে বোধকরি তার অপেক্ষায়ই অতন্দ্র প্রহরীর মতো বরফের মুকুট মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাগীরথী, ত্রিশূল, চৌখাম্বা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...