চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে প্রবেশের পর থেকেই ইতস্ততঃ বোধ করছিলেন কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত অজয় গুপ্ত। আশপাশের বেডগুলির দিকে তাকিয়ে সেখানে দিনের পর দিনে কষ্ট পেতে থাকা রোগীদের দেখে তার মনেও সেদিন ধরা পড়েছিল ভয়। ভোর রাতের হরিধ্বনি কাঁপিয়ে তুলেছিল তার অন্তরাত্মাকেও। কিন্তু হেরে না গিয়ে ক্যানসারকে হারানোর এক অদম্য জেদ তিনি এনেছিলেন তার মনে।
৪৬ এর দাঙ্গার পরে স্বভূমি ছেড়ে এসেছিলেন তিনি। ছোট থেকেই অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি তার পরিবারে পরিচিত ছিলেন এক ডাকাবুকো ব্যক্তি হিসেবে। সেই ডাকাবুকো ব্যক্তি কিনা হেরে যাবে সামান্য একটি রোগের কাছে? এটা মেনে নিতে মনে কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন। তিনি বললেন, "বাংলাদেশ ছেড়ে কয়েকটা অমূল্য পোঁটলা আর আত্মীয়দের সঙ্গে ঠাঁই হয়েছিল দমদম স্টেশন সংলগ্ন হরকালী কলোনিতে। মাটিতে খড় বিছিয়ে ভাইবোনেরা ঘুমোতাম।" অতীত জীবনের কষ্টের কাহিনী তাকে সাহায্য করেছিল বর্তমানের লড়াই লড়তে। তিনি মনস্থির করেছিলেন আবারও তার মধ্যে জাগিয়ে তুলবেন হরকালী কলোনির সেই ডাকাবুকো ছেলেটাকে। তিনি মনকে স্বান্তনা দিয়েছিলেন এই বলে যে, "ভিটেমাটি ছেড়ে আসার পরে প্রতি মুহূর্ত যে লড়াই করেছিলাম, এও তো তেমন লড়াই"।
পেশায় সাংবাদিক অজয়বাবু এই অনিশ্চয়তার সংসারে আনেননি কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে অর্থাৎ বিয়ে করেননি তিনি। একার পেট চালানোর খরচ চালানোর জন্য তিনি শুরু করেন কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা ও বই সম্পাদনার কাজ। তিনি নিজমুখে জানান, "হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র কোনও কালেই নই"। তিনি যেদিন জানতে পেরেছিলেন তার শরীরে বাসা বেঁধেছে কর্কটরোগ ভেঙে পড়েছিলেন তিনিও। পরক্ষণেই মন শক্ত করে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ভারতের সরকারি হাসপাতালেই তাঁর রোগের চিকিৎসা করাবেন। তাঁর মতে, দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং ক্যান্সারে মৃত্যু- মৃত্যুর দুই বিপরীত দিক। প্রথমটি মানুষকে বাঁচার সময় দেয়না এবং দ্বিতীয়টি প্রথমেই জানিয়ে দেয় আপনার হাতে সময় রয়েছে সীমিত। ক্যানসারকে একটি মারণরোগ বলতে ঘোর আপত্তি এই ক্যান্সারজয়ী ব্যক্তিত্বের। তিনি জানান, মৃত্যুর কারণ হল জন্ম। এটাই ধরুন সত্য। আর এই সত্য যত দ্রুত মেনে নেওয়া যাবে ততই সহজ হবে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা। তিনি জানালেন, আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধবদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালেই তাঁর চিকিৎসা করবেন মনস্থির করে ফেলেছিলেন। সেইসময় তার কোলনের সাড়ে ৩ ফুট বাদ দিতে খরচ পড়েছিল মাত্র আড়াইশো টাকা। অস্ত্রোপচার, যানবাহন খরচ সব মিলিয়ে তিনি খরচ করেছিলেন সর্বসাকুল্যে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। তখনকার দিনে এক একটি রোগীকে বাঁচানোর জন্য প্রতিদিন একবার করে বসত মেডিকেল বোর্ড। প্রতিটি রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতো সেখানে। প্রতি কেমোথেরাপির পর ৭০টি করে ক্যাপসুল খেতে হতো তাঁকে। সতর্কবার্তা হিসেবে বলাই ছিল কনস্টিপেশন বা ডায়ারিয়া ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। গত ১১ বছর ধরে এইভাবেই লড়াই করে গেছেন তিনি। অবশেষে ক্যান্সারমুক্ত হয়েছেন সেই সরকারি হাসপাতালে থেকেই। ক্যান্সার আক্রান্তদের উদ্দেশ্যে তিনি জানালেন, "বিশ্বাস করুন, ক্যান্সারের আতঙ্ক জয় করতে পারলে লড়াইটা অনেক সহজ হয়। কি কাজ বাকি আছে, তার তালিকা করে নিন। প্রতিদিন সকালে নিজেকে কথা দিন, সেদিন কোনটি করবেন। শরীর নিয়ে বাতিকগ্রস্ত হবেন না। হাসিখুশি থাকুন। মুহূর্তগুলি প্রাণ ভরে উপভোগ করে নিন"।