বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ করেই সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের একটা মেয়ের নাম। দীপ্তি শর্মা। ২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাঁর ১৮৮ রানের ঝোড়ো ইনিংস নজর কেড়েছিল গোটা ক্রিকেট দুনিয়ার। ১৬০ বলে ১৮৮ রানের ইনিংস সাজানো ছিল ২৭টি বাউন্ডারি ও ২টি ওভার বাউন্ডারিতে। এখনও পর্যন্ত ভারতের হয়ে এটাই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান।
দীপ্তির প্রতিভা নজর কাড়ে প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার হেমলতা কলারের। মাত্র ১৩ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সঙ্গে নেট করতে শুরু করেন দীপ্তি। সেখানেও বাকিদের ছাপিয়ে গিয়ে রাজ্য দলে সুযোগ পান এই তরুণী। জুনিয়র স্তরে পারফর্ম করে ডাক পান উত্তরপ্রদেশের সিনিয়র ও ভারতীয় 'এ' দলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ভারতীয় জার্সিতে অভিষেক হয় তাঁর।
ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ান ডে-তে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড তাঁর। আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওপেন করতে নেমে ১৮৮ রান করেছিলেন ২০১৭ সালে। সেই ইনিংসের পর থেকেই দীপ্তিকে চিনতে শুরু করে ভারতীয় ক্রিকেটমহল। এই ম্যাচের ব্যাট হাতে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলে ভারতের মহিলা দলও। দলগত ৩০০ রানের গণ্ডি পেরিয়ে যান তাঁরা। যেটা বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম।
আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৫৯ রানের বিরাট টার্গেট রাখেন ঝুলনরা। শুধু তাই নয়, ওপেনিং পার্টনারশিপে ভারতের মেয়েরা খেললেন ৩২০ রানের ইনিংস। যেখানে দীপ্তি শর্মা ১৮৮ রানের ইনিংস খেললেন। আহত হয়ে মাঠ ছাড়ার আগে পুনম রাউতের ব্যাট থেকে এল ১০৯ রান। দীপ্তির কথায়, ''ভারতের হয়ে সেই ইনিংস আমাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার পরেই বিশ্বকাপে খেলার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। সেই ইনিংস আমার জীবনের বিশেষ অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে''। ২০১৭ বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ২১৬ রান করার পাশাপাশি ১২টি উইকেটও ছিল এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ও অফস্পিনারের।
২০১৭র বিশ্বকাপের পরেই তিনি চলে এসেছেন বাংলায়। শেষ তিন বছর বাংলার হয়েই রাজ্য স্তরের ম্যাচ খেলছেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর থেকেই ট্রফি জিততে শুরু করে বাংলা। ২০১৯-এ অনূর্ধ্ব-২৩ ওয়ান ডে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন দীপ্তিরা। সে বছরই সিনিয়র ওয়ান ডে-তেও চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলা ঝুলন গোস্বামীর নেতৃত্বে। প্রতিযোগিতায় ৪৮৭ রান করে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন দীপ্তি।
২০১৯ সালে সিএবি-র বর্ষসেরা ক্রিকেটার (মেয়েদের বিভাগে) হন ভারতীয় অলরাউন্ডার দীপ্তি শর্মা। কয়েক বছর ধরেই দুরন্ত পারফর্ম করে বাংলাকে অনূর্ধ্ব-২৩ বিভাগ ও সিনিয়র বিভাগে ট্রফি আনতে সাহায্য করেছেন দীপ্তি। দু’জায়গায় উইমেন অব দ্য সিরিজও হয়েছেন। বাংলা মহিলা ক্রিকেট দলের এই সদস্য জন্ম ১৯৯৭ সালের ২৪ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের আগ্রায়। বাবা তৎকালীন ভারতীয় রেলওয়ের প্রধান বুকিং সুপারভাইজার ভগবান শর্মা আর মা সুশীলা শর্মা। ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট দীপ্তির প্রথম কোচ তার ভাই উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন পেসার সুমিত শর্মা।
বেঙ্গালুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় দীপ্তি শর্মার। আগ্রার মতো ছোট শহর থেকে উঠে এসে ভারতীয় দলে ডাক। সেখান থেকে বিশ্বকাপ যাত্রা। দেশের হয়ে একাধিক ম্যাচে পারফর্ম করার পরে ২০২০ সালে তাঁর হাতে ওঠে অর্জুন পুরস্কার।
যখন দীপ্তি ভারতীয় দলে ডাক পান, তত দিনে ক্রিকেট ছেড়ে চাকরি করছেন দাদা সুমিত। বোনের উন্নতি তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করে যে, চাকরি ছেড়ে তিনি ফিরে আসেন আগ্রায়। বোনের জন্য ক্রিকেট অ্যাকাডেমি তৈরি করার লক্ষ্যে নিজে যুক্ত হন। যাতে কোনও ভাবে পরিকাঠামোর দিক থেকে সমস্যা না হয় দীপ্তির। সেই সময় অর্জুন পুরস্কারের তালিকায় তাঁর নাম ঘোষণা করার পরে দাদাকে ধন্যবাদ দিতে ভোলেননি বোন দীপ্তি। তাঁর কথায়, ''দাদাই আমার অনুপ্রেরণা। ও না সাহায্য করলে এত দূর আসতে পারতাম না। ২০১৭ বিশ্বকাপ খেলার সময় বুঝতে পেরেছি, দাদার শিক্ষা কতটা কাজে লেগেছে। আজ আমি অর্জুন পুরস্কার পেতে চলেছি, বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমার এই সাফল্যের জন্য দাদার অবদান ভুলতে পারব না''।
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন দীপ্তি। তাঁর একমাত্র অনুপ্রেরণা দাদা, সুমিত শর্মা। পেস বোলার হিসেবে উত্তরপ্রদেশের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলেছেন সুমিত। দাদা যখনই অনুশীলনে যেতেন, পিছু পিছু দেখতে যেতেন দীপ্তি। একদিন অনুশীলনের সময় দীপ্তির কাছে একটি বল আসে। দূর থেকে তাঁর দাদার হাতে বলটি ছুড়ে দেন দীপ্তি। মাত্র ১২ বছর বয়সে বোনের হাতের জোর দেখে বিস্মিত হন দাদা। পরের দিন থেকে কানপুরের একলব্য স্পোর্টস স্টেডিয়ামে ছোট বোনকে অনুশীলনে নিয়ে আসেন সুমিত। বাকিটা ইতিহাস।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে আইসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যাটারদের ক্রমতালিকায় ১৮ নম্বরে উঠে এসেছেন দীপ্তি। সেই সময় কিউয়িদের বিরুদ্ধে তিনি ৬৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। সেই দুরন্ত ইনিংসের সুবাদেই আইসিসি-র এক দিনের ক্রমতালিকায় দু'ধাপ উঠে আসেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় এক দিনের ম্যাচে চার উইকেট নিয়ে বোলারদের ক্রমতালিকাতেও ছ'ধাপ এগিয়ে ১৩ নম্বরে চলে আসেন দীপ্তি। অলরাউন্ডারদের ক্রমতালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি হয়ে যাওয়া বার্মিংহাম কমনওয়েলথে সোনা জয়ের কাছে গিয়েও হারতে হয়েছে দীপ্তিদের। আরও একবার দ্বিতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলকে। কমনওয়েলথ গেমসে সোনার আশা জাগিয়েও রুপো নিয়ে দেশে ফিরেছেন তাঁরা। ২০১৭ সালের এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালের স্মৃতি উস্কে দেয় কমনওয়েলথ গেমসের ফাইনালে ভারতীয় মহিলা দলের হার। উল্লেখ্য এই দুই দলেরই সদস্য ছিলেন দীপ্তি শর্মা।