সত্য যুগের ঘটনা। ভগবান শিব প্রায়ই উত্তরবঙ্গের বোরোদের ঘরে ভাঙ খেতে আসতেন নাকি। এই জনজাতির মহিলারা পরম যত্নে মহাদেবকে ভাং খাওয়াতেন। দেবীর কাছে এই খবর পৌঁছে যায়। নিজের স্বামীর এমন দুরাচারে দেবী ভীষণ রেগে যান। সরাসরি বোরোদের গ্রামে চলে যান। পার্বতীর সঙ্গে বোরো মহিলাদের তুমুল ঝগড়া বাঁধে। কথিত আছে এই বোরো মহিলারা নাকি ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। পার্বতী ভাবেন এই সৌন্দর্যের মাধ্যমেই তারা ভগবান শিবকে বশ করে তাকে ভাং খাওয়াতে পারেন। তিনি সেই বোরো মহিলাদের অভিশাপ দেন যে তাঁদের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। যে সৌন্দর্যের জোরে তাঁরা মহাদেবকে নেশাগ্রস্ত করতে পারে সেই সৌন্দর্যই তাঁদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। এই অভিশাপ দিয়ে দেবী পার্বতী রাগের মাথায় লাথি মেরে বোরো মহিলাদের নাক ভোঁতা করে দেয়।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী দেবী পার্বতী নিজের গৃহে ফিরে আসেন বটে কিন্তু স্বামীর এই দুরাচারকে মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারেন না। রাগে, দুঃখে, হিংসায় পার্বতীর ভেতর এক রূপের জন্ম হয়। এই রূপ ভীষণ সুন্দর। সহজ কথায় ভয়ংকর সুন্দর। এমন সুন্দর রূপ যা ধ্বংসের কারণ। এই সুন্দর রূপ শুধু সৌন্দর্যই ভালোবাসে। লোকশ্রুতি দেবী পার্বতীর এই রূপই হল সুন্দরমালা।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলার রাভা সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে এই সুন্দরমালা দেবীর পুজোর চল রয়েছে। ঐতিহাসিকরা বলেন সুন্দরমালার এই মালা কথাটি হল আসলে গলার ফাঁস অর্থাৎ গলার দড়ি। শোনা যায় যদি কেউ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন এবং বিফল হন এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির উপর নাকি দেবী সুন্দরমালা ভর করেন। দেবী সুন্দরমালা সেই ব্যক্তির সামনে অপরূপ নারীর বেশে আসেন। তাঁর সৌন্দর্যে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন সেই আত্মহত্যা করা প্রচেষ্টাকারী ব্যক্তি। দেবী সুন্দরমালা মিষ্টি গলায় তাকে বলেন “আয়... তোকে মালা পরিয়ে দিই”। এই মালা আসলে গলার দড়ি। যে গলার দড়ি ব্যক্তিটি পরতে গিয়েও বিফল হয়েছেন অর্থাৎ আত্মহত্যা করতে পারেন নি, দেবী সুন্দরমালার উদ্যোগে সেই ব্যক্তি গলায় দড়ি দেন এবং তাঁর মৃত্যু হয়।
শোনা যায় এই দেবীর মূল উদ্দেশ্যই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা করা ব্যক্তিটিকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া। সেই ব্যক্তির চেনা কোন মানুষ যেমন তার প্রেমিকার স্ত্রী, বান্ধবী বা অন্য কোন চেনা মানুষের ছদ্মবেশে ওই ব্যক্তির সামনে এসে ভুলিয়ে বলবে "আয় আমরা একসঙ্গে মরে যাব, মরবি না আমার সঙ্গে!" আর এই চেনা মানুষের মুখ দেখে আত্মহত্যা করতে যাওয়া ব্যক্তিটি নিজের গলায় দড়িটি যদি পরে ফেলেন তাহলে তার মৃত্যু আটকানো আর সম্ভব নয়। কেউ বলেন সেই ব্যক্তি যদি ফাঁদ বুঝে না এগিয়ে সুন্দরমালা দেবীর উদ্দেশে প্রণাম জানান তাহলে নাকি দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে তখনকার মতো রেহাই দিয়ে চলে যান। তবে আত্মহত্যার প্ররোচনা চলতেই থাকে।
কোন ব্যক্তি যদি আত্মহত্যার কথা চিন্তাও করেন, দেবী সুন্দরমালা নাকি ওই ব্যক্তির পিছনে পড়ে যায়। ক্রমাগত তাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করতে থাকেন। অদ্ভুত বিষয় হল সুন্দরমালা সব সময়ই কোন নারীর বেশেই আসেন। কোন পুরুষের বেশ ধরে আসেন না।
রাভা সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ মজার ছলেও যদি গলায় কাপড় দেয় তাহলে বাড়ির বড়রা তাকে বকাঝকা করেন। এই অঞ্চলের স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি গলায় ফাঁস দিয়ে মরতে গিয়েও না মরে তার ওপর সুন্দরমালা ভর করলে সেই ব্যক্তিকে ওঝা দিয়ে দেবীর পূজা করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। এই প্রায়শ্চিত্ত করার মূল উদ্দেশ্য দেবীর সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
সুন্দরমালা দেবীর কোন নিত্য পুজো হয় না। অনুষ্ঠান বা মূর্তি নেই আলাদা করে। প্রায়শ্চিত্ত করতেই তার পুজো দেওয়া হয়। সুন্দর মালার পুজো বাড়ির ভিতর হয় না। বাড়ির বাইরে একটি কলা পাতায় অপরূপ সুন্দর মুখাবয়ব এঁকে তার পুজো করতে হয়। এই দেবীকে সধবার রূপে কল্পনা করা হয় এবং দেবীর নাকে থাকে নোলক।
পুজোয় উপকরণ বলতে কলার ঝুঁকি, ঘট, সুপারি, পান, কলার কাঁদি, আমের পল্লব এবং ডাব বসানো লাল শালুকের মোড়ানো ঘট। এছাড়া পাঁচ রকম ফল, দুধ, কলা চিনি, বাতি এবং ধূপ ধুনো প্রয়োজন হয় এই দেবীর পুজো করতে।
এই দেবীর পুজোয় পুরোহিত লাগে না। পুজো হয় তান্ত্রিক মতে। পুজোর সময় আক্রান্ত ব্যক্তির দুই পায়ের মাঝে একটা কালো কচু চাপা দিয়ে রাখতে হয় তারপর কাঁচি দিয়ে কচুটা কাটতে হয়। এই কচুকাটার সংকেত হল সুন্দরমালা দেবীর সঙ্গে আত্মহত্যা করতে যাওয়া ব্যক্তির সংযোগ কেটে দেওয়া। কোন বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা হয় না।
বলি কোথাও নেই এই দেবীর পুজোর ক্ষেত্রে। তবে কিছু কিছু জায়গায় শোনা যায় যদি কোন ব্যক্তি বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিফল হয়েছেন সে ক্ষেত্রে সুন্দরমালা দেবীকে শান্ত করতে পায়রা বা পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। মনে করা হয় একটি প্রাণী বা জীবন্ত জীব উৎসর্গ করলে সুন্দরমালা আরেকজন জীবকে রেহাই দেবেন। তবে কোন প্রাণী বলি দেওয়া হলে তার মাংস খাওয়ার অধিকার কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির নেই। ওঝা বা তান্ত্রিক বলির প্রসাদের অংশীদার হন। সেই অর্থে করুণাময়ী বা মমতাময়ী নন, তবুও লৌকিক অপদেবতা হিসেবে দেবী সুন্দরমালার পরিচয় রয়েছে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে লৌকিক বিশ্বাস বেঁচে থাকে।