উনিশ শতকের ট্রেন্ডসেটার ও ফ্যাশান ডিজাইনার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন উনিশ শতকের নামজাদা ব্যবসায়ী, বড় জমিদার।  তাঁর ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তা, তিনি সৌখিন হবেন না তো, আর হবেন কে! তাঁর খানিক বিলাসিতা থাকবে, চারটে শখ আহ্লাদ থাকবে, এ আর বেশি কি! 

ছোটবেলায় দেবেন্দ্রর পায়রা পোষার দারুণ শখ ছিল। গামছা বা তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে তাঁর ভীষণ কষ্ট হত। সারাজীবন তাই মসলিনের সুক্ষ্ম ও নরম কাপড় দিয়েই তিনি গা মুছতেন। শুধু তাঁর জন্যই রাশি রাশি মসলিনের থান আসত ঠাকুরবাড়িতে। আর ছিল গুচ্ছের রুমাল, একটা রুমালে একবার মুখ মুছেই মেঝেয় ফেলে দিতেন।  না কাচা অব্দি দ্বিতীয়বার তাতে মুখ বা হাত মুছতেন না। নতুন জামাকাপড় বারকয়েক পরেই ফেলে দিতেন, চাকর-বাকরেরা সেসব পরে পরে ছিঁড়ত। তিনি নিজে যেমন ধোপদুরস্ত ছিলেন, তাঁর কাছে যেতে হলে সেভাবেই যেতে হতো। তেতালার বারান্দায় যখন কৌচে বসতেন, পাশের টেবিলে রাখতে হতো সাদা ফুল-- বেল, জুঁই বা শিউলি। উনি বলতেন, 'গন্ধপুষ্প'।  সেখানে বসে তিনি যখন বই পড়তেন, গল্প করতেন; তখন 'বুল বুল' শব্দ তুলে আলবোলায় সুগন্ধি তামাক খেতেন। এও তাঁর শখের জিনিস। চুরুটের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। ভালোবাসতেন পাতলা সৌখিন কাঁচের গেলাসে ঘনজ্বাল দেওয়া দুধ খেতে।  দুধ যাতে মিষ্টি হয়, সেজন্য গরুকে আচ্ছা করে গুড় খাওয়ানো হতো। কালোয়াতি গান শেখার শখও তাঁর হয়েছিল একবার, পূরণ হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। তবে, সাহেব মাস্টার রেখে পিয়ানো বাজাতে যে শিখেছিলেন, এটা জানা যায়।

খেয়ালি এই মানুষটিই, শখ-আহ্লাদ আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে হয়ে উঠেছিলেন উনিশ শতকের সাজপোশাকের একজন ট্রেন্ডসেটার। 

সেকেলে কলকাতায় বড়লোক-অভিজাত পুরুষেরা গোঁফ রাখতেন, কেউ কেউ সঙ্গে দাড়িও রাখতেন। তাই বাড়ির চাকরবাকরদের একদম ক্লিন সেভ থাকতে হত। কেতাসর্বস্ব কলিকাতায় চাকর আর বাবুর এক কেতা তো আর হতে পারে না! প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে ঠাকুরবাড়িতে বাবুরা গোঁফ রাখতে পারতেন, দাড়ি নয়। এ-বাড়িতে দাড়ি রাখার প্রথা চালু করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেটাও চালু হয়েছিল বেশ নাটকীয়ভাবে নাটকের মধ্য দিয়ে।

সেসময় বেয়াড়া বাবুদের নিয়ে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'নববাবু বিলাস' নামের ব্যঙ্গরচনাটিকে প্রহসন হিসেবে গুছিয়ে নিয়ে বাড়িতে অভিনয় করাবেন বলে রোখ চাপল দেবেন্দ্রনাথের। অভিনয় করবেন বাড়ির ছেলেরা, কর্মচারী ও পারিবারিক বন্ধুরা। ভাগনে ঈশ্বর মুখার্জিকে দারোয়ান সাজতে হবে। সাজপোশাক নকল হবে না, চুলদাড়িও আসল হতে হবে। দেখে মনে হয় যেন আসল দারোয়ান! ফলে, হুকুম হল 'চালাও পানসি বেলঘরিয়া', বাড়াও দাড়িগোঁফ। কাজেই অবাধে বাড়ল সেসব। অভিনয়ের সময় এমন হলো যে, সেই চুল পাটি করে আঁচড়াতেই ঠেকল এসে দাড়ি আর গালপাট্টায়। তখন ঈশ্বরকে এমন মানালো যে, সবাই বলল, 'অসাধারণ'! দেবেন্দ্রনাথেরও দেখে এতটাই ভালো লাগল যে, নিজেও চুল আর দাড়ি বাড়াতে শুরু করলেন। তারা যখন বাড়ল, তখন চোখে পরতে শুরু করলেন মানানসই গোলফ্রেমের সোনার চশমা। ব্যস, তাঁর দেখাদেখি ঠাকুরবাড়ির উঠতি ছেলেছোকরাদের কাছে সেটাই হয়ে গেল তখনকার ফ্যাশান। অল্পদিনেই এই ট্রেন্ড ছড়িয়ে পড়ল ঠাকুরবাড়ির বাইরেও। আর এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারেই রবীন্দ্রনাথের দাড়িগোঁফ ও লম্বা চুলের বাহার!

 ১৮৪৮ সালে বিলেতে মারা গেলেন বাবা দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যবসাবাণিজ্যে তিনি যেমন অনেক টাকাকড়ি করেছিলেন, তেমনি মারা যাওয়ার আগে অনেক দেনাও করে গেলেন। দেনার দায় বর্তালো দেবেন্দ্রনাথের ওপর। তিনি মানী লোক। ফলে, বাবার দেনা পাইপয়সা ধীরে ধীরে মিটিয়ে দিলেন। আর সেসব মেটাতে গিয়ে তাঁর তখন কপর্দকশূন্য অবস্থা। বিশাল ঠাকুরবাড়ির অবস্থাও তাই  ডামাডোল।

এইরকম পরিস্থিতিতে বাবু দেবেন্দ্রনাথ নিমন্ত্রণ পেলেন শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে। সেখানে গানের জলসা হবে। সেই জলসায় কলিকাতা শহরের মানীগুনী বাবু, বড়লোক এবং জমিদারেরাও আমন্ত্রিত। সেখানে যে কি পরিমাণ বড়লোকি ঘটা হবে, নিজেকে জাহির করতে অঙ্গে হিরেজহরতের জাঁকজমক হবে, সে সবাই আন্দাজ করতে পারছিলেন। আর বাবু দেবেন্দ্রনাথের অবস্থার কথাও তো সবারই জানা। তাই তাঁরা ভাবতে লাগলেন, এই আমন্ত্রণে দেউলে দেবেন্দ্রনাথ কি আসবেন? এলেও, কোন সাজে আসবেন? বাবুদের চামচামহলেও চলতে লাগল কানাঘুষো।

এদিকে দেবেন্দ্রনাথও ভাবছেন সাধারণ বেশে গেলে মান থাকে না, না-গেলেও মান যায়। গায়ে সেকালের প্রথা অনুযায়ী দামী পোশাক আর অলংকারের জাঁক করার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই। তিনি ভাবতে শুরু করলেন, নিজের সামর্থ্যে কীভাবে ঝামা ঘষে দেওয়া যায় আদেখলা বাবুদের মুখে। ভাবতে ভাবতে তাঁর মাথা থেকে বেরুলো এক দারুণ উপায়!

ঠাকুর বাড়িতে অর্ডারি গয়নার জোগান দেন করমচাঁদ জহুরী। তাঁকে ডেকে দেবেন্দ্রনাথ বরাত দিলেন মখমলের জুতোয় মুক্তো বসিয়ে দিতে। করমচাঁদ দুধ সাদা মখমলের জুতো তৈরি করালেন। তারপর শিল্পীমনের ছোঁয়ায় মুক্তো দিয়ে অপূর্ব সজ্জায় সাজিয়ে দিলেন জুতোজোড়া। সে এক দেখার মতো জিনিস হল বটে। তবে মুক্তোর দাম আর মজুরি, ধারের খতিয়ানে জমিদারি খাতায় লেখা রইলো। এগুলো বছর শেষে শোধ হবে।

তবে জলসার দিন সাজ করলেন বটে দেবেন্দ্রনাথ! গায়ে সাদা আচকান, মাথায় 'মোড়াসা পাগড়ি', পায়ে সাদা মুক্তোখচিত সাদা মলমলের জুতো। সাদায় সাদায় তিনি যেন এক সৌম্য ঋষি, সবার থেকে আলাদা। এই সাজে জলসায় ঢুকতেই, গমগমে সভা তাঁকে দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তাঁর শ্বেতবসনের ছটায় রাজরাজড়ার হিরেজহরত যেন ম্লান হয়ে গেল। স্মিত হেসে মুক্তোখচিত পাদুকা দুখানি বের করে তিনি সভায় এসে বসলেন। আর সেই পাদুকায় চোখ পড়তেই তামাম বাবুদের মুখ চুন! শেষটা বলি অবনীন্দ্রনাথের কথায়---খোদ শোভাবাজারের রাজা ছেলেছোকরাদের ইশারা করে বললেন, 'দেখ তোরা দেখ, একবার চেয়ে দেখ এ দিকে, একেই বলে বড়লোক। আমরা যা গলায় মাথায় রেখেছি ইনি তা পায়ে রেখেছেন।'

এই সৌখিন মানুষটি মারা গেলেন ১৯০৫ সালে। তাঁর প্রিয় সাদা ফুলে সাজিয়ে দেওয়া হল শেষ শয্যা। শহরভাঙা শোভাযাত্রায় ছড়ানো হল প্রিয় ফুল আর আবীর। সাজানো হল চন্দন কাঠের চিতা। রবীন্দ্রনাথ ও দাদারা মুখাগ্নি করলেন। দাউ দাউ জ্বলে উঠল আগুন। 

তথ্যঋণ : ঘরোয়া-- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীমতী রাণী চন্দ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...