আমরা যাঁকে ‘দেবব্রত বিশ্বাস’ বলি, যাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত আর গণসঙ্গীত শুনে আমাদের প্রাণে, আমাদের রক্তে নেশা ধরে; তাঁকে কাছের মানুষেরা ডাকতেন 'জর্জদা' বলে। কারণ, তাঁর ডাকনাম ছিল, ‘জর্জ’।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও দেশটা স্বাধীন হয়নি। স্বাধীন হওয়ার জিগির চলছে। জাতের নামে দেশ ভাগের চক্রান্ত চলছে। হিন্দু-মুসলমানকে একে অপরের সঙ্গে লড়িয়ে দেওয়া গেছে। কাটাকাটি-মারামারি-খুন-ধর্ষণ-কালোবাজারি প্রভৃতি যা যা দরকার সবই শুরু করিয়ে দেওয়া গেছে।
এই রকম এক প্রেক্ষাপটে সম্প্রীতির বার্তা আর মানবিক অধিকার নিয়ে গণজাগরণের লক্ষ্যে গণনাট্য সংঘ তৈরি হয়েছে। তাতে যোগ দিয়েছেন উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কলিম শরাফি, খালেদ চৌধুরি, সলিল চৌধুরির মতো তাবৎ তাবড় শিল্পীরা। তাঁরা পথে-ঘাটে-গাঁয়ে-গঞ্জে-শহরের বুকে গানে-নাটকে গণজাগরণের জোয়ার আনার চেষ্টা করছেন।
সে এমন এক সময় যেখানে হিন্দুরা দেখছে মুসলিমদের সন্দেহের চোখে, মুসলিমরাও তাই। যখন-তখন লাশ পড়ছে।
কলিম শরাফি এমনই এক সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনে নামলেন। বৃষ্টি হয়েছে। চারদিক থমথমে। কিছুক্ষণ আগেই হাঙ্গামা হয়েছে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখলেন সব শুনশান। নর্দমার পাশে একটা লাশ। বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠল। চোরাগোপ্তা হানায় তিনিও অমন লাশ হয়ে উঠতে পারেন! যে-কোন সময়।
পথে যখন নেমে পড়েছেন ফেরার আর উপায় নেই। সামনে-পিছনে গোপন মৃত্যু অপেক্ষমাণ। কলিম এগোনই স্থির করলেন। কোনরকমে ভয়ে-আতঙ্কে আড়ালে লুকিয়ে, ঘাতকদের চোখ বাঁচিয়ে, অনেক রাতে হাঁটতে হাঁটতে রাসবিহারীতে এসে পৌঁছলেন।
তখন দেবব্রত বিশ্বাস থাকতেন রাসবিহারী এভিনিউতে। তাঁর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন কলিম। দেবব্রত তাঁকে দেখে নিজের অবাক হওয়ার ভাবটুকু দেখারও সময় দিলেন না। কলিমকে ঘরে টেনে ঢুকিয়ে তক্ষুনি দরজা বন্ধ করে একেবারে সোজা খাটের তলায় চালান করে দিলেন। কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলেন না মুসলিম কলিমকে বাড়িতে তিনি ঠাঁই দিয়েছেন। হিন্দু অধ্যুষিত এই অঞ্চলে কাউকে তিনি তা জানতেও দেবেন না। কানাকানি হয়ে কলিম বিপদে পড়ুক তিনি চান না। তিনি জানেন, ঘাতকবাহিনী সর্বক্ষণ শিকার খুঁজে টহল দিচ্ছে।
এমনি করে দিন যাচ্ছে।
হঠাৎ একদিন দরজায় অস্থির টোকা। ঘরের ভেতরে তখন কলিম ও দেবব্রত চাপা গলায় গল্প করছিলেন। টোকার বহর দেখে কলিম হতভম্ব। কিন্তু দেবব্রত তিড়িং করে একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর কলিমকে সটান খাটের তলায় ঠেলে চালান করে দিয়ে ভেতর আড়াল করে দরজা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়ালেন।
না, সেই ফাঁক বেয়ে কোন ঘাতককে দেখা গেল না। দেখা গেল, গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। হেমন্তও উল্টো ফাঁকে দেখতে পেলেন দেবব্রতর মুখের খানিক। তিনি অবাক হলেন, তাঁকে দেখেও দরজার ফাঁক কিন্তু আর এক ইঞ্চিও বাড়ল না। সেই ফাঁক থেকেই আওয়াজ এল, কও?
সঙ্গীত ছাড়া আর সব প্রসঙ্গতেই দেবব্রত তাঁর ওপার বাংলার মাতৃভাষা বজায় রাখেন। ঠিক বজায় রাখেন হয়তো নয়, তিনি বলেন, 'আইয়া পড়ে'।
হেমন্ত তাঁকে আদর করে 'কাকা' বলে ডাকেন। দু’জনে দারুণ বন্ধুত্ব। দেবব্রতর দরজা হেমন্তর জন্য অন্যদিন দরাজ খোলা থাকে। কিন্তু আজকের ভাবগতিক দেখে হেমন্ত বুঝলেন, ও দরজা এই মুহূর্তে এর বেশি আর ফাঁক হবার নয়।
ফলে, যে-জন্য এসেছেন, সেটা তৎক্ষণাৎ নিবেদন করলেন। বললেন, কাকা, ক'দিন ধরে কলিমটার কোন খোঁজ পাচ্ছি না। খুব চিন্তা হচ্ছে, চাদ্দিকে যা সব চলছে! তোমার এখানে কি এসেছিল?—হেমন্তর গলায় স্পষ্ট উৎকণ্ঠা ধরা পড়ল।
কিন্তু দেবব্রত সেই উৎকণ্ঠার ধার দিয়েও গেলেন না। অত্যন্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, আমার এহানে আইব, পাগল হৈছস! দেখ হয়ত মইরা গেছে গিয়া!
হেমন্ত, কলিম ও দেবব্রত তিনজনই গণনাট্য সংঘের সক্রিয় কর্মী। কলিম বেপাত্তা। অথচ কাকার এহেন নির্লিপ্তি হেমন্তর ঠিক হজম হল না। হতাশ এবং ভাবিত হওয়ার এই মুহূর্তে হেমন্তের মনে একটা সন্দেহ জেগে উঠল, কাকা নিশ্চয়ই কিছু জানে, রহস্য একটা নির্ঘাত আছে! কিন্তু হেমন্ত মুখে কিছু না-বলে বাড়ি ফিরে গেলেন।
অনেক পরে, যখন কলকাতা মোটামুটি শান্ত হল, কলিম কাকার নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে এলেন; তখন হেমন্ত বুঝলেন তাঁর অনুমানই ঠিক। আর বুঝলেন মানুষ হিসেবে কাকা কতবড় খাঁটি...