শীতের বাগানে চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, গাঁদার পাশে কিছু ‘ঈশ্বরের ফুল’ এবার অবশ্যই রাখুন। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, ‘ঈশ্বরের ফুল’, সেটা আবার কী? আসলে, আমি যে ফুলটার কথা বলছি, তার নাম ‘ডায়ান্থাস’। এটি একটি গ্রিক নাম। এর মানেই হল, ‘ঈশ্বরের ফুল’। গ্রীসে প্রাচীনকাল থেকে আজও এই ফুলটিকে উপাসনা ও ধর্মীয়সজ্জায় ব্যবহার করা হয়। প্রেম নিবেদনেও এই ফুল ব্যবহার করা হত সেখানে। যাই হোক, ফুলটি কিন্তু অতীব সুন্দর। শার্পনার দিয়ে উডপেন্সিল ছোলার পর যে লেডমাখা কাঠের সুদৃশ্য কোঁচকানো ফালি বেরিয়ে আসে, সেগুলোই যেন অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ফুলের পাঁপড়ি হিসেবে—ফুলটিকে দেখলে হরবখত যেন এটাই মনে হয়। এমন অনন্য ডিজাইন আর এত রঙের শেডস আছে এই ফুলের যে, দেখলেই মন ভরে যায়। এক-কালার ও মিক্স-কালারে এই ফুলের টব যদি পাশাপাশি এক থেকে দুই সারি রাখা হয়, কিংবা এক তবে দু'তিন রকম রঙের চারা বসিয়ে ফুল ফোটানো হয়; তাহলে ছাদবাগান বা ব্যালকনিবাগানের চেহারাই পাল্টে দেয় সে। তাই বলছিলাম যে, এই শীতে আপনার বাগানে চিরাচরিত ফুলের পাশাপাশি কিছু মাল্টিকালার ডায়ান্থাসও এবার চাষ করুন।
আপনার হাতে যদি গাছের পরিচর্যা করার মতো তেমন সময় না-থাকে; এবং আপনার ছাদবাগান বা ব্যালকনিবাগানে দিনে মাত্র তিন থেকে চার ঘন্টা বেশ ভালো রোদ আসে, তাহলেও আপনি নির্দ্বিধায় ডায়ান্থাস চাষ করতে পারেন। কেননা, অল্প পরিচর্যায় এই ফুল শীতের পূর্ণ রোদে যেমন ভালো হয়, তেমনি আলো-ছায়াতেও প্রচুর ফুল দেয়। তিন ঘণ্টার কম রোদ পেলে, ফুল কিছু কম দেয় এই যা। ফলে, বাগানে রোদ কম এলেও নিরাশ হবার কিছু নেই, এই ফুলের চাষ আপনি করতে পারেন। বিশ্বাস করুন, ডায়ান্থাস আপনাকে নিরাশ করবে না।
ডায়ান্থাসের কমবেশি তিনশো রকমের ভ্যারাইটি আছে। বাজারে গেলে আপনি বিভিন্ন রঙে ‘ডায়ান্থাস’ নামে চারা যেমন পাবেন; তেমনি পাবেন ‘সুইট উইলিয়াম’ ও ‘বেবিডল’ নামের চারাও। ভিন্ন নাম হলেও এগুলো ভিন্ন ফুলের গাছ নয়। আসলে, এগুলোও ওই ডায়ান্থাসেরই একেকটা প্রজাতি। এগুলো সিঙ্গল পাঁপড়ির হয়ে থাকে। যাই হোক, চারা নেবেন একদম সতেজ ও সুস্থ এবং থাম্বপটে রয়েছে কিনা দেখে। উপড়ে আনা চারা না-নেওয়াই ভালো। একান্তই যদি নিতে হয়, তাহলে বাড়িতে এনেই আধ চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড ও দুই চা-চামচ এপসম সল্ট আধলিটার জলে ভালো করে গুলে তাতে গাছের কাণ্ড অব্দি দু’তিন ঘন্টা ডুবিয়ে রাখবেন। এ-ধরণের চারা আনার দিনই টবে বসাবেন। আর থাম্বপটের চারা দিন-তিনেক পর।
চারা টবে বসাবেন দোআঁশ মাটির ওপর। দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, দেড় ভাগ বিল্ডিং তৈরির হলদেটে মোটা বালি, এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক-দেড় বছরের পুরনো গোবর সার এবং এক চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড একসঙ্গে ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেই ডায়ান্থাসের উপযুক্ত মাটি তৈরি হয়ে যাবে। চারা বসাবেন চার বা ছয় ইঞ্চির টবে। এটি গুচ্ছমূলজাতীয় গাছ, এর শেকড় খুব গভীরে যায় না। তাই এর জন্য এর চেয়ে বেশি বড় টবের কোন প্রয়োজন নেই। টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক করে রাখতে নীচে বালি ও স্টোনচিপসের একটা দুই-আড়াই ইঞ্চির লেয়ার তৈরি করে তার ওপর মাটি দিয়ে আশি ভাগ ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত করে চারাটি বসিয়ে দিতে হবে। থাম্বপটের চারা বসানোর পর পর্যাপ্ত প্লেইন জল দিয়ে টবের মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। পাতায় সামান্য ফাঙ্গিসাইড মেশানো জল স্প্রে করে দিয়ে পাঁচ থেকে ছ’দিনের জন্য ছায়ায় রেখে দিতে হবে। আর উপড়ে আনা চারা বসানোর পর ফাঙ্গিসাইড ও এপসম সল্ট মিশ্রিত জল গাছের গায়ে ছড়িয়ে সেটা দিয়েই টবের মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। দিনের বেলায় এই টব ছায়ায় থাকবে, রাত্রে বাইরে শিশিরে রাখতে হবে। এটা চলবে সাতদিন। দুই ক্ষেত্রেই টবের মাটি না-শুকোলে জল দেওয়ার একেবারেই কোন প্রয়োজন নেই। দুই ক্ষেত্রেই গাছ বেশ সতেজ দেখা গেলে, ছায়া-পিরিয়ড পেরোবার পর রোদযুক্ত নির্দিষ্টস্থানে টব এনে বসিয়ে দিতে হবে।
গাছ বসানোর দিন পনেরো পর থেকে শুরু হবে খাবার দেওয়া। শুধু খোল পচা জল পাতলা করে দিলে সাতদিন পর পর দিয়ে যেতে হবে। আর এই খোলপচা জলের সঙ্গে লিটারে গুণে গুণে দশ-পনেরো দানা ইউরিয়া ভালো করে গুলে নিয়ে টবের মাটিতে দিলে, এই মিশ্রিত খাবার দশ দিন পর পর দিলেই হবে। মাসে একবার এক লিটার জলে দশ থেকে বারো দানা ডিএপি ভালো করে গুলে তা টবে খাবার হিসেবে দিতে হবে। এতে গাছের স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকে, তেমনি তা গাছের সঠিক সময়ে কুঁড়ি আনতেও সাহায্য করে। এছাড়া সিঙ্গল সুপার ফসফেট মাসে একবার টব প্রতি এক থেকে দেড় চা-চামচ গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে খুঁচিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
অধিকাংশ গাছই টবের প্যাঁচপ্যাঁচে মাটি পছন্দ করে না। ডায়ান্থাসের রুচিও এরকম। তাই তাকে জল দেবেন তখনই, যখন দেখবেন, তার টবের মাটির ওপরদিকটা সামান্য শুকনো শুকনো মনে হচ্ছে। অন্যদিকে প্যাঁচপ্যাঁচেভাব দূর করতে গিয়ে টবের মাটি খটখটে শুকনো হয়েও যাতে না-যায়, এটাও খেয়াল রাখতে হবে। দু’চার বার এমনটা হলে সমস্যা নয়। কিন্তু বার বার এমনটা ঘটলে গাছের ক্ষতি হয়। সে বৃদ্ধি পাবার ও সতেজ হয়ে থাকার অর্থাৎ ভালোভাবে বাঁচার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। শেকড়ে ছত্রাকের আক্রমণও তখন সে ঠেকাতে চায় না। তাই জল দিতে হবে নিয়ম করে, বুঝে বুঝে, পরিমাণমতো।
টবের মাটি সপ্তাহে একবার কাঁটাচামচ দিয়ে ওপর ওপর আলতো করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আলগা করে দেবেন। এতে মাটিতে সুন্দরভাবে বাতাস চলাচল করে গাছের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। তাছাড়া এতে করে টবের জলনিকাশি ব্যবস্থাও ভালো থাকে। মাটি খোঁচানোর সময় মাটিতে যেন হালকা হালকা রস থাকে; কাদা কাদা বা খটখটে যেন না-হয়—এটা খেয়াল রাখবেন। তাহলেই দেখবেন, ডায়ান্থাসের টবের মাটি ঝুরঝুরে ফুরফুরে মোলায়েম হয়ে রয়েছে। শুধু ডায়ান্থাস নয়, বাগানের সব গাছের সব টবের মাটিতেই এই পরিচর্যাটুকু খুবই প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী।
শীতের আর-পাঁচটা ফুলের মতোই ডায়ান্থাসেরও যত ডাল তত ফুল থিয়োরি রয়েছে। শীত পড়লেই অর্থাৎ নভেম্বরের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহ থেকেই গাছে কুঁড়ি আসতে শুরু করে। তাই এর আগে পর্যন্ত পিঞ্চিং করে ডালের সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হবে। কুঁড়ি আসার আগে পিঞ্চিং বন্ধ করতে হবে। ফুল এলে যোগ হবে অন্য-একটা কাজ। সেটা হচ্ছে, ফুল ফুটে শুকিয়ে গেলেই বৃতিশুদ্ধ সেটা ছিঁড়ে ফেলতে হবে। বৃতিতে বীজ থাকে, গাছকে এখনই বীজ তৈরি করতে দিলে গাছ সেদিকেই তার সমস্ত মনোযোগ বাড়িয়ে ফুল দেওয়া কমিয়ে দেয়। তাছাড়া বীজ পুষ্ট হতে প্রচুর খাদ্যশক্তির ব্যয় হয় এবং তাতে গাছের নিত্যপ্রয়োজনীয় পুষ্টিতে ঘাটতি হয়। কাজেই তাতে ফুলের আকার ছোট হয়, পরিমাণ তো কমেই। গাছও অকালে বুড়ো হয়ে যায়। এ-সব কারণেই শুকনো ফুল বৃতিসহ তুলে ফেলে দিতে হয়। এটা নিয়ম করে ও একটু সময় বের করে যদি করতে পারেন, তাহলে আপনার বাগানে সারাটি শীতে ফুলের কমতি হবে না কখনই।
মার্চ মাসে গরম পড়লে তখন ফুল এমনিতেই কমে আসে। এই সময় বীজ তৈরির জন্য শুকনো ফুল তুলে ফেলা বন্ধ করে দিন। তারপর বৃতি পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে সেটা তুললেই তার ভেতরে পাবেন কালোজিরের মতো দানা দানা বীজ। এগুলো শুকনো হাওয়া-বন্ধ কৌটোয় রেখে দিন বর্ষায় বুনে চারা তৈরির জন্য। এই মার্চ মাসে গরম ও রোদের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কাজ আপনাকে করতে হবে, সেটা হল ডায়ান্থাসের টবগুলোকে ছায়ায় সরিয়ে ফেলতে হবে। আগের জায়গায় অর্থাৎ রোদে রাখলে গাছ মরে যাবে। কিন্তু এ-গাছ এভাবে মরতে দেওয়া তো চলবে না। কেননা, এই গাছ ছায়ায় রাখলে এবং আগের মতোই নিয়মিত খাবার ও জল দিয়ে গেলে ভরখর গ্রীষ্মতেও বেঁচে থাকবে তো বটেই নিয়ম করে অল্প অল্প ফুলও দেবে। আবার শীত পড়লে সেই গাছই আপনার বাগান এ-বছরের মতোই ফুলে ফুলে ভরিয়ে রাখবে। ডায়ান্থাসের জীবন ছ’মাসের নয়, সামান্য যত্নেই সে দু’তিন বছর বাঁচে।
তাহলে আর কী, এভাবেই অত্যন্ত সহজে এবার আপনার বাগান ডায়ান্থাসের সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলার জন্য শুরু করে দিন প্রস্তুতি, পারলে আজই...