র‌্যাডক্লিফ লাইন ও রাতারাতি ভিটে-মাটি হারানো মানুষদের কথা

স্বাধীনতা বড় সুখের জিনিস, আবার সে বেদনারও বটে। যে দেশ দু'শো বছরের পরাধীনতার গ্লানি ভোগ করেছে, সে দেশের জল, হাওয়া, মাটি, পঞ্চভূত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে এই সত্যের কথা। হাজারও প্রাণের বিনিময়ে, রক্ত ঝরিয়ে যে স্বাধীনতা এসেছিল তার সঙ্গে মিশেছিল বিষ। সে'বিষ সাম্প্রদায়িকতার; ব্রিটিশ বারবার ভারতকে ভাঙতে চেয়েছে। এই ভাঙতে চাওয়ার কারণ ছিল, ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার মরিয়া ইচ্ছে ও চেষ্টা। দীর্ঘদিন উপমহাদেশের মাটিতে রাজত্ব করে যাওয়ার অভিসন্ধি থেকেই জন্ম হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনার, র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের সম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতিরও জন্ম একই উদ্দেশ্যে। পীড়িত, শোষিত উপমহাদেশবাসীকে শাসন করে যাওয়ার মন্ত্রই ছিল মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে, দানা বাঁধা লড়াইকে ভেঙে ফেলা। নিজেদের দিকে উঠে আসা তরোয়ালের ধারকে ভোঁতা করে দেওয়া।

IMG-20230814-WA0037

যদিও তাতে একেবারে সফল হয়নি, সাহেবদের দল। নেতাজি হাবিবুরদের বরাবর পাশে পেয়েছেন কিন্তু ওই যে বিষ, তা প্রোথিত হয়েছিল মজ্জায় মজ্জায়। একদিন তার বহিঃপ্রকাশ হলই। নৌবিদ্রোহ ও আজাদ হিন্দ বাহিনী সংগ্রাম ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে উপমহাদেশকে যে আর অধীনে রাখা যাবে না, তা বেশ বুঝতে পেরেছিল শাসক শ্রেণী। চিরাচরিত নিয়মে ক্ষমতা হস্তান্তরই ছিল পথ। তা হল, স্বাধীনতা এল। কিন্তু শেষ সম্বল হারিয়ে ফেলল বহু মানুষ। তাঁদের পরিচয় হল উদ্বাস্তু, ভাল বাংলায় শরণার্থী। নাম, পরিচয় হারিয়ে তাঁরা হয়ে উঠল সংখ্যা। গুনতির জীবনে দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি, আজও তাঁদের দৌড় থামেনি। ছুটে বেড়াচ্ছে যাঁরা আজও।

সাগর পেরিয়ে র‌্যাডক্লিফ সাহেব এলেন, লাইন টানলেন। দেশ দু'টুকরো হল। জন্ম হল দুটি স্বাধীন দেশের। জন্ম হল অহীনকূল শত্রুতার। সাতচল্লিশ একটা দগদগে ক্ষতর জন্ম দিয়ে গেল। দেশভাগ নাটক, নভেল, সিনেমার প্লট হয়ে উঠল, কাব্য লিখলেন কবিরা। কিন্তু যাঁদের সব গেল, তাঁদের গেলই। রাতারাতি কোটি কোটি মানুষ হারাল ভিটে-মাটি। প্রদীপ দেওয়া তুলসী তলা বেদখল হল এক মুহূর্তে। নামাজ পড়া উঠোনে বন্ধ হল আজানের অপেক্ষা।

ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার সময় দ্বিজাতিতত্ত্বের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিল দেশের মেরুদণ্ড বরাবর। দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার আড়ালে কর্কট ঢুকে গিয়েছিল বাঙালির জাতিসত্ত্বায়। সাহিত্য,  সংস্কৃতি, শিল্প সর্বত্র জাতিবিদ্বেষ ও বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়ে, তবে বিদায় নিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সেই কারণেই আজও দাদু, ঠাকুমাদের চোখ জলে ভরে ওঠে পনেরোই আগস্টে। ভারতের স্বাধীনতার আনন্দকে দেশভাগের যন্ত্রণা বহুলাংশে ম্লান করে দেয়। স্বাধীনতা জন্ম দিয়েছিল নিজ ভূমিতে পরবাসী এক ছিন্নমূল শ্রেণীর। তাঁরা শহীদ না হয়েও যেন শহীদ। ইতিহাসের পাতা তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামী বা স্বাধীনতার সেনানী হাওয়ার মর্যাদা দেয়নি। কিন্তু তাঁদের বলিদানও যে কম কিছু নয়। এক লহমায় বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন হারানো মানুষগুলো হারিয়েই গেল। ইতিহাস তাঁদের মনে রাখে না, হয়ত ইতিহাসের সে তাগিদ নেই। কিন্তু স্মৃতি ভিড় করে আসে, কারও করিম চাচা, কারও জীবন কাকাদের ভিড়ে ফের স্পষ্ট হয়ে ওঠে র‌্যাডক্লিফ লাইন। পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভর্তি গরু আর মাঠ ভরা সোনালী ধানের স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করে ওঠে একটাই শব্দ তাঁদেরও একখানা দ্যাশ ছিল। স্বাধীনতার মোড়কে যা বেদখল হয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...