শীত মানেই আমাদের ফুলবাগানে হাজার বিদেশি ফুলের মেলা। কিন্তু সে মেলায় আদ্যিকালের গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা আর ডালিয়া না-থাকলে কেমন যেন ঠিক জমে না, বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই যেমন প্রতিটি পাড়ার নিত্যদিনের আড্ডায় দু’একজন থাকে দেখবেন, তারা যেদিন কোন কারণে আসে না, সেদিন আড্ডা যেন কিছুতেই জমে না, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমাদের ফুলজীবনের জমাটি আড্ডায় গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা আর ডালিয়ার ভূমিকাও তাই। সারাটা শীতকাল এরা রঙে-রূপে এমন মজিয়ে রাখে যে, বংশপরম্পরায় এরা আমাদের আবেগের সঙ্গে ভালোলাগার সঙ্গে স্মৃতির সঙ্গে এক্কেবারে লেপ্টে রয়েছে; এদের ছাড়া শীতটা কিছুতেই জমে না। তাই এই শীতে আমাদের ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে অবশ্যই এদের চাষ করব। আগের একটি কিস্তিতে চন্দ্রমল্লিকা চাষ ও পরিচর্যার কথা সবিস্তারে বলেছি, এবার বলব ডালিয়ার কথা।
ছাদ বা ব্যালকনিতে সারাদিনে মিনিমাম তিনঘণ্টা রোদ এলেই সেখানে ডালিয়া চাষ করা যাবে। আর যদি পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা রোদ আসে, তাহলে তো একেবারে যাকে বলে সোনায় সোহাগা। ডালিয়া নভেম্বর থেকেই ফুল দিতে শুরু করে, ফুল দেওয়া শেষ করে যখন মার্চে গরম খুব বেড়ে যায়, তখন। তাও নয় নয় করে টানা পাঁচ মাস চুটিয়ে ফুল দেয় সে।
ডালিয়ার প্রতি আমাদের দুর্বলতার প্রধান কারণ হল দুটি। তার ফুলে বিভিন্ন রকম রঙের সমাহার। তাতেই আমাদের বাগান সে যেন আলো করে রাখে সারাটি শীত জুড়ে। কেননা এর এক-একটি ফুল সাত থেকে দশদিন তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে সতেজ থাকে। এছাড়াও এই ফুলের অন্যতম আকর্ষণ, তার পাঁপড়ির অসাধারণ বিন্যাস। পাঁপড়ির বাহার অনুযায়ী ডালিয়া হচ্ছে দু’রকমের—একসারি পাঁপড়ির ফুল অর্থাৎ পাতি ফুল এবং বহুসারি পাঁপড়ির ফুল অর্থাৎ থোকা ফুল। এই দুই রকমের ফুলেরই নানান ভ্যারাইটি আছে, তাদের নানান ইংরিজি নাম; আমাদের সে-সবের কচকচির মধ্যে যাবার দরকার নেই। কাছের কোন নার্সারি বা পাড়ার মোড়ের গাছবিক্রেতা দাদা, যার কাছ থেকেই চারা কিনুন-না-কেন, যে রঙের ডালিয়া চাষ করতে চান, সেই রঙের ডালিয়ার চারা চাইবেন। সিঙ্গল পেটাল বা পাতি জাতের যদি আপনার পছন্দ, তাহলে সেটা চাইবেন। আর থোকা পছন্দ হলে, থোকা চাইবেন। কিংবা মিলিয়ে-মিশিয়ে নিতে চাইলে তাই নেবেন। আমি বলতে চাইছি, নিজের পছন্দটা তাঁদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবেন। ওঁদের ওপর ছেড়ে দেবেন না। বাজারে দু’রকমের চারা পাওয়া যায়—বীজের চারা ও কাটিং চারা। পাতির ক্ষেত্রে বীজের চারা হলেও চলবে, কিন্তু থোকার বেলায় কাটিং থেকে তৈরি চারা অবশ্যই নেবেন। কাটিংচারার গাছে মাদার প্ল্যান্টের ফুলের কোয়ালিটি নিশ্চিতভাবেই বজায় থাকে। প্রতিটি চারাই বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখে কিনবেন। দেখবেন, প্রতিটাই যেন পটে থাকে। উপড়ে আনা চারা কিনবেন না।
চারা কিনে আনার পর তাকে সাতদিন একটা আধো আলো আধো ছায়া জায়গায় রেখে দেবেন। এ-ক’দিন মাটি শুকোলে শুধু জল দেবেন। সাতদিন পর এই চারা ছয় থেকে আট বা দশ ইঞ্চি টবে লাগানোর ব্যবস্থা করবেন। দোআঁশ মাটিতে ডালিয়া খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। দেড় ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে দেড় ভাগ বালি এবং এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে ঝুরো ঝুরো করে মিশিয়ে নিলেই উপযুক্ত দোআঁশ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এবার টবের নীচে তিন ইঞ্চির একটা লেয়ার করতে হবে কুচো পাথর ও বালি দিয়ে, এতে টবের বাড়তি জল সহজেই বেরোতে পারে। এই লেয়া্রের ওপর তৈরি করা মাটি দিয়ে টবের আশি ভাগ ভর্তি করতে হবে। তারপর টবের ঠিক মধ্যিখানে চারাটির কাণ্ড অব্দি বসানো যায়, এমন গর্ত করে তাতে এক চিমটে রাসায়নিক ফাঙ্গিসাইড বা একমুঠো হলুদ গুঁড়ো দিয়ে থাম্বপট থেকে চারাটি ধীরে ধীরে মাটিশুদ্ধ বের করে ওই গর্তে বসিয়ে মাটি দিয়ে চারপাশ ভরাট করে বেশ ভালোভাবে চেপে দিতে হবে। চারার চারপাশ ভালোভাবে চেপে দিলে চারপাশের মাটির মধ্যে চারা তাড়াতাড়ি শিকড় ছড়ায় এবং শেকড়ের চারপাশ এতে টাইট হয়ে থাকায় সেখানকার মাটি বাড়তি জল ধরে রেখে শেকড়ের ক্ষতি করতে পারে না।
এখানে একটা কথা বলি, চারাটি যদি পলিপ্যাকে থাকে, তাহলে ঝামেলা নেই পলিপ্যাক ব্লেড বা কাঁচি দিয়ে আলতো করে কেটে ফেলে চারা বসাতে সুবিধে হয়। কিন্তু মাটির থাম্বপটের চারা অনেকেই বের করতে পারেন না, পট ভাঙতে গিয়ে অনেকেই অযথা চারা নষ্ট করে ফেলেন। আসলে থম্বপট ভাঙতে হয় না। পলিপ্যাকের চারা হোক বা থাম্বপটের চারা, যেদিন তাকে টবে লাগাবেন তার আগে দুটোর মাটিই যেন শুকনো শুকনো থাকে। এই অবস্থায় থাম্বপটের নীচে আঙুল দিয়ে টুসকি মারুন, কানায় মারুন আস্তে আস্তে; ব্যস, দু’একবারের টুসকিতেই দেখবেন চারাকে জড়িয়ে ধরে মাটি পট থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এবার আর কী, তাকে আলতো করে তুলে টবে বসিয়ে দিন।
টবে চারা লাগানোর পর মাটি ভাসিয়ে জল দিন, তারপর টবশুদ্ধু গাছটিকে ছায়ায় রাখুন তিনদিন। চতুর্থদিনের দিন তাকে হালকা রোদ পায় এমন জায়গায় রাখুন। এখানে দু’দিন রেখে ছ’দিনের দিন তাকে সেই রোদেলা জায়গায় রাখুন, যে জায়গাটা তার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে।
চারা লাগানোর দিন থেকে দশদিন পর্যন্ত এই গাছকে কিচ্ছু খাবার দিতে হবে না। এগারো দিনের দিন থেকে চালু হবে তার খাবার দেওয়ার পর্ব। প্রতিটি গাছের জন্য চা-চামচের এক চামচের তিনভাগের এক ভাগ ইউরিয়া, আধ চামচ পটাশ, এক চামচ ফসফেট একসঙ্গে মিশিয়ে টবের ধার ঘেঁষে গাছের গোড়া থেকে দূরে গোল করে দিয়ে সেই জায়গার মাটি খুঁড়ে দেবেন। যখন এই সার দেবেন মাটি তখন সামান্য ভেজা ভেজা থাকবে, এটা দেওয়ার এক ঘণ্টা পর টবে পুরো জল দেবেন। এই রাসায়নিক সার খাবার দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ম করে প্রতি পনেরদিন অন্তর সিজন শেষ হওয়া পর্যন্ত দিয়ে যেতে হবে। পটাশ গাছে তাড়াতাড়ি ফুল আনে, ইউরিয়া গাছকে সবুজ-সতেজ রাখে, গাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটায় এবং ফসফেট গাছের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, নানান রোগের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে এবং ফুলের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে। এছাড়াও কুড়ি-পঁচিশদিন পর পর গোবর সার ও ভার্মি কম্পোস্ট দু’ মুঠো করে দিয়ে যেতে হবে গাছের গোড়ায়। এর সঙ্গে তিন দিনের পচানো সরষেখোলের জল বা পনের দিনের সবজির খোসা পচানো জল পাতলা করে এটা-একবার ওটা-একবার অলটারনেট হিসেবে সাতদিন অন্তর দিতে পারলে খুবই ভালো হয়। যারা রাসায়নিক সার একেবারেই প্রয়োগ করতে চান না, তারা সাতদিন অন্তর অলটার-পদ্ধতিতে সব্জির খোসাপচা জল ও সরষের খোলপচা জল দেবেন। সেই সঙ্গে প্রতি দশদিন অন্তর দু’মুঠো করে গোবর সার ও ভার্মি কম্পোস্ট অলটার-পদ্ধতিতে দিতে থাকবেন।
ডালিয়ার টবে অতিরিক্ত জল কখনই দেবেন না। আবার মাটি খটখটে হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে, এটাও যেন না হয়। মাটি যেন সব সময় হালকা ভেজা ভেজা থাকে, এমনভাবে জল দেবেন। টবে আগাছা একেবারেই হতে দেবেন না। মাটি সাতদিন পর পর শক্ত কাঁটাচামচ দিয়ে খুঁচিয়ে আলগা করে দেবেন। মাটি ঝুরঝুরে থাকলে, তাতে হাওয়া-বাতাস চলাচলের সুযোগ পায়, তাতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ডালিয়ায় একটু রোগপোকার প্রকোপ দেখা যায় বটে, কিন্তু তাতে মহামারীকাণ্ড কিছু হয় না। জাব পোকা এই গাছে খুব আক্রমণ করে। এই পোকার আক্রমণ হলেই এক লিটার জলে চা-চামচের আধ চামচ যে-কোন কোম্পানির সাবান গুঁড়ো বা সমপরিমাণ শ্যাম্পু নিয়ে ভালো করে জলে গুলে সকালবেলায় পর পর তিনদিন স্প্রে করে দিন, একটাও পোকা থাকবে না। সব মরে যাবে। এছাড়াও থ্রিপস বা চুষি পোকার আক্রমণ হয় এর গাছে। এই পোকারা রস চুষে পাতা ও গাছ, কুঁড়ি, ফুল সব নষ্ট করে। এদের সাদা সাদা ডিম পাতার ওপর দেখা যায়। এছাড়াও আরও বেশ কয়েক রকমের পোকা এই গাছের ক্ষতি করে। এসব পোকা ঘরোয়া টোটকায় সহজে দূর হয় না। তাই এদের আক্রমণ হলে ইমিডাক্লোরোপীড গ্রুপের কীটনাশক নির্দ্বিধায় স্প্রে করে দিন, একদিন বা দু’দিন সকালে। ব্যস, তাতেই সব পোকা মরে-হেজে শেষ হয়ে যাবে।
ডালিয়ার কাণ্ড ডালপালার ভার খুব একটা ভার নিতে পারে না। তাই গাছকে সোজা রাখতে গাছের বাড়ন্ত অবস্থাতেই টবে একখানা বেশ শক্তপোক্ত কাঠি পুঁতে গাছটিকে বেঁধে দিতে হয়। এই গাছে বেশি ফুল পেতে আপনাকে চন্দ্রমল্লিকার থিয়োরিই প্রয়োগ করতে হবে—যত ডাল, তত ফুল। গাছের মূল আগাটিতে যে কুঁড়ি আসে, তাতেই সবচেয়ে বড় ফুলটি ফোটে। তাই সেই আগাটিকে অক্ষত রেখে তার যে শাখাপ্রশাখা হবে তাদের দু’চারটি পাতা দেখা দেওয়ার পর পরই ডগা ভেঙে দিতে হবে। সেখান থেকে নতুন দুটো ডাল গজাবে। তাদের ডগা ভাঙলে আরও নতুন দুটো দুটো চারটে ডাল গজাবে। এভাবে ডালের সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে হবে। এসব চলবে নভেম্বরের শুরু অব্দি। এরপর ভাঙাভাঙি বন্ধ। কেননা, এবার গাছে কুঁড়ি আসবে, ফুল ফুটবে; নতুন ডাল গজাবে ছন্দে, নিজের প্রয়োজনে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাধের ছাদ বা ব্যালকনিবাগান রঙে-বাহারে ভরিয়ে ডালিয়া তার ফুল ফোটানোর পালা শেষ করবে। এই সময় রোদের তাপ বেশ বাড়তে শুরু করে, এটা আর ডালিয়া সহ্য করতে পারে না। সে মরে যেতে শুরু করে। এবার আপনি যেটা করবেন, সেটা হচ্ছে পরের বছরের ডালিয়া চাষের প্রস্তুতি। একবার চারা কিনেছেন, পরের বার আর কিনবেন না। নিজেই চারা তৈরি করবেন। গাছ মরে এলে শুকোনোর আগেই গাছটি উপড়ে মাটি খুঁড়ুন। মাটিতে শাঁকালুর মতো দেখতে বেশ কিছু কন্দ পাবেন। এগুলো তুলে ভালো করে ফাঙ্গিসাইড মাখিয়ে বাচ্চাদের নাগালের বাইরে আধো অন্ধকার কোন স্থানের মেঝেতে রেখে দিন। এভাবে রেখে দিলে এগুলো ভালোভাবে থেকে যাবে। বর্ষার ঠিক আগে এগুলো সেখান থেকে বের করে মাটিতে বসাবেন, তখন এগুলো থেকেই নতুন চারা তৈরি হবে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এগুলো গাছ মরার পর টবের মাটিতে থাকলে কী হত, সময় এলে ওখানেই তো আপনাআপনি চারা গজাত? না গজাত না। গাছ মরে শুকিয়ে গেলেই গরমে মাটির নীচে ওগুলো পচে নষ্ট হয়ে যেত। যাই হোক, কন্দ থেকে তৈরি চারা বেড়ে উঠলে তার ডগাশুদ্ধু ডাল কেটে কাটা অংশে রুট হরমোন মাখিয়ে বেলেমাটিতে পুঁতে দিলেই আট-দশদিনে নতুন চারা তৈরি হয়ে যায়। এভাবে কাটিং থেকে বর্ষায় আপনারা অনেক নতুন চারা তৈরি করতে পারবেন। কাটিং থেকে চারা আপনি জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেও করতে পারেন। নার্সারিতে পুরনো গাছ থেকে এভাবে এ-সময় থেকেই মাদার প্ল্যান্ট তৈরি করে রাখে। রোদ তাপ থেকে বাঁচিয়ে শেডে ওরা বেশ যত্ন করে রাখে। সেভাবে আপনিও রাখতে পারেন।
তাহলে আর কী, এভাবেই এবার ডালিয়ার চাষ করুন। নতুন নতুন চারা তৈরি করুন। আর অন্তরের সমস্ত আবেগ দিয়ে ফুলের চাষ করুন। কেননা, এর মতো পবিত্র নেশা আর কিচ্ছুতে নেই, কিচ্ছুতে হয় না।।...