লক্ষ্মী মা আসছেন। আসছেন হিমমাখা ধানের গোছা হাতে নিয়ে, সদ্য ফোটা লাল পদ্মের সবুজ মৃণাল নিয়ে, বরাভয়ের মুদ্রা ও সৌভাগ্য-ঐশ্বর্যের ডালি নিয়ে। কারণ, দেবী চতুর্ভুজা।
আজ আশ্বিন সংক্রান্তি। আজ, 'ডাক'। 'ডাক' কথার অর্থ, 'আমন্ত্রণ'। বাঁকুড়ার লোকসংস্কৃতিতে এ-দিন গেরস্তের গৃহলক্ষ্মী ধানের ক্ষেতে ক্ষেতে গিয়ে ধান্য লক্ষ্মীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন গেরস্তের ঘরে আসার জন্য। এই আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি এ-দিন প্রতীকী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যাপিত হয়। এই অনুষ্ঠান আশ্বিন সংক্রান্তিতেই হয়, তাই আশ্বিন সংক্রান্তিকে এই অঞ্চলে 'ডাক সংক্রান্তি'-ও বলে।
অনুষ্ঠানের লক্ষণীয় বিষয় হল, মাঠে 'ডাক' বা 'আমন্ত্রণ' জানাতে যাওয়ার জন্য গৃহলক্ষ্মী সাজেন একজন পুরুষ। ব্রাহ্মণেতর জাতির পুরুষ। এ-দিন তিনি এয়োতি নারীর মতো শাড়ি পরেন, কানে-নাকে পরেন সোনার গয়না, হাতে শাঁখাপলাবালা আর কপালে দেন সিঁদুর। ক্ষেতে গেরস্তের হয়ে শষ্যের দেবীকে তিনি যেমন আমন্ত্রণ জানান, তেমনি গেরস্তের জন্য নিয়ে আসেন দেবীর আদেশ।
সেই আদেশ নিয়ে তিনি ক্ষেত থেকে সোজা এসে দাঁড়ান গেরস্তের উঠোনে। ভেতর ঘরের দিকে হরতুকি ছুঁড়ে জানান দেন যে, তাঁর আগমন হয়েছে। তখন ঘরের ভেতর থেকে বাড়ির গিন্নি তিনটি প্রশ্নে দেবীর আদেশ জানতে চান। এই জানতে চাওয়া এবং জানানোর বিষয়টি গতে বাঁধা প্রশ্নোত্তরে নির্দিষ্ট। যথা--
প্রঃ মা লক্ষ্মীমা কি বললেন?
উঃ খামারখোলা চাঁছতে বললেন।
প্রঃ মা লক্ষ্মীমা কি বললেন?
উঃ গোবরছড়া দিতে বললেন।
প্রঃ মা লক্ষ্মীমা কি বললেন?
উঃ সাকবড় পাকাতে বললেন।
এই প্রশ্নোত্তরের অর্থ হল :
প্রথম আদেশে দেবী বলছেন যে, 'খামারখোলা চাঁছা' অর্থাৎ মাঠের ধান ঘরে আনতে হলে আগে গেরস্তকে খামার (যেখানে ধান এনে রাখা হয়, ঝাড়াই করা হয়) থেকে বর্ষায় গজিয়ে ওঠা ঘাস ও আগাছা পরিস্কার করতে হবে।
দ্বিতীয় আদেশে দেবী বলছেন, সেই পরিষ্কার করা খামার 'গোবরছড়া' অর্থাৎ গোবরগোলা জল দিয়ে ভালো করে লেপে-পুছে নিকোতে হবে। দেবীর বরে সেই খামার উপচে পড়বে নতুন ধানে।
তৃতীয় আদেশে দেবী বলছেন, 'সাকবড়' পাকাতে। আসলে, খামারে ঝাড়া ধান মজুত করে রাখতে বেশ কিছুকাল আগেও মরাই (ধানের গোলা) বাঁধতে হত। মরাই বাঁধার জন্য পাকাতে হত বিচুলির মোটা দড়ি। দড়িটি পেঁচানো হত মরাইয়ের সারা গায়ে। এই দড়িরই নাম ছিল, 'সাকবড়'।
বাঁকুড়ার লোকসংস্কৃতিতে এই যে 'ডাক' অনুষ্ঠান, এর একটা অসম্ভব মাধুর্য আছে। অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, গৃহলক্ষ্মী গেরস্তের বাড়িরই একজন। তিনি নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন মাঠের অন্নঅঙ্গা দেবীকে আবাহন করে ঘরে আনার। গেরস্তকে সমৃদ্ধ করার দায় যেন তাঁরই।
সেই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, ধান্য লক্ষ্মী গৃহলক্ষ্মী মারফৎ জানিয়ে দিচ্ছেন, কেমন করে সামান্য ব্যবস্থাপনা করলেই তিনি গেরস্তের ঘর আলো করবেন, সেই কথা। পুরো ব্যাপারটাই এমন আন্তরিকতা-আত্মীয়তার পরিচায়ক যে, অনুষ্ঠানটি ঘোষণা করে কৃষক ও দেবী নিছক ভক্ত-ভগবান বা উপাসক-আরাধ্যা নন, তাঁরা দু'জনে দু'জনের পরম আত্মীয়।
আত্মীয়তার এই সূত্রের সঙ্গে দেবী ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর দুই শ্রেণিকেই অদ্ভুত সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে-ব্রাহ্মণেতর মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়োজনে মাঠ থেকে ধান কেটে খামারে এনে ঝেড়ে গেরস্তের গোলা ভরে দেন, তাঁরাই হচ্ছেন সমাজ-সংসারের প্রকৃত 'গৃহলক্ষ্মী'। আর এই গৃহলক্ষ্মীর কোন লিঙ্গভেদ নেই। তাই ঐতিহ্য বেয়ে 'ডাক'-এ আজও ব্রাহ্মণেতর পুরুষ 'গৃহলক্ষ্মী' সাজেন।
ঐতিহ্য ও আত্মীয়তার বহুধা রেশ বয়ে বাঁকুড়া তথা রাঢ়-বাংলার 'ডাক' পরবের ধারাটি এগিয়ে চলেছে আজও। তবে, আজ বাঁকুড়ার গ্রামে গ্রামে ধানের গোলা বা মরাই বাঁধার চলপ্রায় নেই বললেই চলে, তাই দেবী অাসার অাগে খামার পরিস্কার করা হলেও 'সাকবড়' পাকানোর উদ্যোগ এখন আর নেই।
তবুও লোক-ঐতিহ্যের হাত ধরে ফি-বছর অনুষ্ঠিত হয় 'ডাক' পরব, থাকে লক্ষ্মীমায়ের আবাহনের জন্য বছরভরের অপেক্ষা। বস্তুত, এই 'ডাক' অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সূচিত হয় 'নবান্ন লক্ষ্মী'র পুজোর আগ্রহে অনতি-অপেক্ষার ক্ষণ...