আবার চলে এসেছি মালদার মালপত্র নিয়ে। "মালদার" শব্দটি অনেক সময় কথ্য শব্দ হিসেবে আমরা ব্যবহার করি কোন ধনী মানুষকে বোঝানোর জন্য। সত্যি কথা বলতে গেলে মালদহ বা মালদা জেল কিন্তু কম "মালদার" নয়।
অর্থাৎ মালদহ জেলার ঐতিহ্যগত ধনসম্পদ কম তো নয়ই বরং অনেক অনেক। মুর্শিদাবাদের মতো প্রচারের দিক থেকে অতটা এগিয়ে না থাকলেও মালদা জেলাতে যত ঐতিহাসিক স্থাপত্য রয়েছে ততগুলো হয়ত মুর্শিদাবাদেও নেই।
গত সপ্তাহে তো আমরা দাখিল দরওয়াজা দেখে বেড়ানো শেষ করেছিলাম। এই সপ্তাহে বাকি দেখার জায়গাগুলোও দেখে নিই। চলুন যাত্রা শুরু করি ফিরোজ মিনার দিয়ে।
দাখিল দরওয়াজা থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাঁচ তলার এই মিনার, নাম ফিরোজ মিনার। ১৪৮৫ থেকে ৮৯ সালের মধ্যে বিজয়ের স্মারক হিসেবে এই মিনার তৈরি করেছিলেন সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। এর উচ্চতা ২৬ মিটার ও প্রস্থ ১৯ মিটার।
দিল্লির কুতুব মিনারের মতো দেখতে তুঘলকি কারুকার্য সহ নির্মিত পাঁচ তলা ফিরোজ মিনারের দেওয়ালে পোড়ামাটির অপরূপ কাজ দেখলে দর্শক মুগ্ধ হবেনই। মালদা টাউন রেল স্টেশন থেকে ১৭ কিলোমিটার এবং দাখিল দরোয়াজা থেকে মোটামুটি এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থাপত্যকে স্থানীয় লোকেরা চিরাগ মিনারও বলে থাকেন। সম্ভবতঃ আজানের সময় এখানে চিরাগ বা প্রদীপ জ্বালানো হতো তা থেকেই এই নাম এসেছে।
এবার যাব লুকোচুরি দরওয়াজা দেখতে। তুর্কি সুলতানরা এবং মুঘল শাসকরা তাদের শাসনামলে এই গৌড়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন একের পর এক দৃষ্টিনন্দন সৌধ। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো লুকোচুরি দরওয়াজা। মুঘল আমলে ভারতের প্রদেশগুলিকে বলা হতো সুবাহ্ এবং তার শাসককে বলা হতো সুবাহদার।
বাংলার সুবাহদার শাহ সুজা ১৬৫৫ সালে গৌড় দুর্গে প্রবেশ করবার জন্য তৈরি করেছিলেন এই প্রবেশদ্বার বা দরওয়াজাটি। এই শাহ সুজা ছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র। মনে করা হয় যে সুলতানরা তাঁদের বেগমদের সঙ্গে এখানে হয়তো লুকোচুরি খেলতেন। সম্ভবতঃ এই সৌধের আসল নাম ছিল শাহি দরওয়াজা।
ইট দিয়ে তৈরি এই ফটকটির তিনটি তলা রয়েছে। ওপরের ছাদ নক্করখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গৌড় দুর্গে সুবাহদাররা যখন প্রবেশ করতেন অথবা প্রস্থান করতেন, এই ছাদ থেকে তার ঘোষণা হত। এই ফটকের দুদিকে ছিল প্রহরীদের ঘর এবং ওপরে ছিল নহবতখানা। সুবাহদার অথবা বিশিষ্ট কোনো অতিথি এলে ওপর থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হত, নহবতখানায় বাজানো হত সানাই।
এই লুকোচুরি দরওয়াজা দিয়ে ঢুকে আমরা দেখে নিতে পারি কদমরসুল সৌধ। লুকোচুরি ফটক বা শাহি দরওয়াজা দিয়ে গৌড় দুর্গে ঢুকে ডানদিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যাবে কদমরসুল সৌধ। এই কদম রসুল সৌধে রয়েছে হজরত মহম্মদ (সাঃ)-র পদচিহ্ন। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র স্থান এই কদমরসুল সৌধ।
আরব থেকে পীর শাহ জালাল তাব্রেজি এই পবিত্র পদচিহ্ন সম্বলিত একটি পাথর এনেছিলেন পান্ডুয়ার বড়ো দরগায়, সেখান থেকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ সেই পবিত্র পাথর নিয়ে আসেন গৌড় দুর্গে। ১৫৩০-৩১ সালে তাঁর ছেলে সুলতান নসরত শাহ একটি কোষ্ঠি পাথরের বেদির ওপর পদচিহ্নটি স্থাপন করে তার ওপর কদম রসুল সৌধ তৈরি করান।
আজ এই পর্যন্তই বেড়ানো হোক। শুরুতেই লিখেছিলাম যে "মালদার" জেলা হিসেবে মালদার তুলনা নেই। আরো সুন্দর সুন্দর মালপত্র মানে দ্রষ্টব্য স্থান বাকি রয়েছে এখনো। পরের দিন যাব মা জহুরা চণ্ডীর মন্দিরে.... তিনশো বছরের পুরনো মালদহের জহরা কালিমায়ের দর্শন করতে। হোক না মানস ভ্রমণ... ক্ষতি কী?