স্টার ইন্ডিয়া গেট

বিজয় চাঁদ রোড এবং গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের সংযোগ স্থলে বর্ধমান শহরে ঠিক ঢোকার মুখেই কার্জন গেট। সাবেক রাজপ্রাসাদটি গেট থেকে ১ কিমি দূরে অবস্থিত।

১৯০৪-র ৪ঠা এপ্রিল ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় ও বড়লাট মার্কুইস জর্জ ন্যাথানিয়ল কার্জন এই গেট উদ্বোধন করেন। তখন এই তোরণের নাম দেওয়া হয়েছিল স্টার গেট অফ ইন্ডিয়া’ প্রায় ৬৫ ফুট উঁচু। ইঁটের তৈরি। নির্মাণ কাজ চলেছিল এক বছর ধরে। বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাব বাহাদুরের উদ্যোগে। ১৯০৩ সালের জানুয়ারি মাসে এই তোরণের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয় এবং পুরো কাজ শেষ হয় ১৯০৪ সালের মার্চ মাসে।

তখনও ফটোগ্রাফার-ক্যামেরার যুগ আসেনি। কিন্তু বাংলার প্রতাপশালী ব্রিটিশরাজ প্রতিনিধি কার্জনের সম্মানে বাংলার বুকে তোরণ উদ্বোধনের মত ঘটনা স্মরণে রাখার জন্য বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তোরণ উদ্বোধনের দৃশ্য ক্যানভাসে ধরে রাখা হয়েছিল। তেল রঙের ছবিতে। এঁকেছিলেন ডেনমার্কের শিল্পী হুগো পেডারশন। তাঁর আঁকা সেই ছবি ব্রিটিশ ভারতীয় পাশ্চাত্য শিল্পের অমূল্য সম্পদ।

তোরণ রূপায়নের দায়িত্বে ছিল 'ম্যাকিনতোশ বার্ণ' কোম্পানি। বার্ণ কোম্পানিতে সেই সময় বহু বিদেশি স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ যুক্ত ছিলেন। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি থেকেও কলকাতায় এসে কাজ করতেন তাঁরা। তোরণের ডিজাইন ও পরিকল্পনা করেন এঁরাই।

কিন্তু ব্রিটিশ রাজের অজ্ঞাতসারে, অনুমতি ছাড়া কোনও কাজই সম্ভব ছিল না। এই তোরণটির পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন বড়লাট লর্ড কার্জন আর ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার বোর্ডিলিয়ন সাহেব। তাদের অনুমতি ছাড়া পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না বর্ধমানের মহারাজের পক্ষে।

তোরণ তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভাবে ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে। গ্রিক- রোমান ঘরানার মিশ্রণ ঘটেছিল।

তোরণ নির্মাণ পদ্ধতিও ছিল বেশ অন্যরকম। একশ ফুট বাই একশ ফুট ব্যাসের প্রায় ৩০ ফুট গভীর খাদের মাটি খোঁড়ার পর মাটির ভিতর একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। সেই ভিতের নীচে বালি, পাথর দিয়ে শক্ত গাঁথুনি গাঁথা হয়। সেই গাঁথুনি ধীরে ধীরে তোলা হয় মাটির ভিতর। প্ল্যাটফর্মের মত ধাপে ধাপে ওঠে তোরণ।

১৯০৪ সালে ফাঁকা ল্যান্ডস্কেপের ওপর প্রবেশদ্বারটি অনেকটা প্যারিস শহরের 'আর্চ অফ ট্রাই অ্যামফে'-র মতন লাগত। কিন্তু এখন কংক্রিটের জঙ্গলে ‘স্টার গেট অফ ইন্ডিয়া’র সেই ভিউ আর নেই। কল্পনাতেও আনা দুষ্কর।  

তোরণ তৈরির আগে-পরের ইতিহাসও খুব আকর্ষণীয়। ঘটনাবহুল বলা যায়। ১৯০৩ সালে ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার বোর্ডিলিয়ন সাহেবের উপস্থিতিতে বিজয় চাঁদের রাজ্যাভিষেক ঘটে। সেই বছরেই তোরণের পরিকল্পনা এবং কাজ শুরু। পরের বছর ১৯০৪-এ বর্ধমান পরিদর্শনে আসেন লর্ড কার্জন। স্টার গেট অফ ইন্ডিয়ার দ্বারোদঘাটন করে, সেই পথ দিয়েই তাঁর শহরে প্রবেশ। পরবর্তী সময়ে ইংরেজ প্রভুর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য বিজয়চাঁদ গেটের নাম বদলে ‘কার্জন গেট’ রাখেন। 

লর্ড কার্জন পর পর দুবার ভারত সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বারের শাসনকালকে (১৮৯৯-১৯০৪) ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

ভাইসরয় লর্ড কার্জন ছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রবক্তা। ভারতে কিন্তু এদেশে তিনিই প্রথম ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন এমন না। ইংরেজ রাজের বঙ্গদেশ ভাঙ্গার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। কার্জন সেই পরিকল্পনাকে ‘রাতারাতি’ কার্যকর করতে চেয়েছিলেন।

 তিনি যে বছর বর্ধমান পরিদর্শনে আসেন ওই বছরই অর্থাৎ ১৯০৪ সালেই বঙ্গ ভাগের প্রস্তাব আনা হয়। যা একেবারেই কার্জনের মস্তিষ্কপ্রসূত। কার্জন ভেবেছিলেন বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বাংলা প্রদেশকে দুটো অংশে ভাগ করে শাসন করতে হবে। নতুন একটি প্রদেশ করা হবে। যার নাম হবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ। পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। শিক্ষিত ও অভিজাত হিন্দুদের বড় অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একপর্যায়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর পালটে দেওয়া হয় ‘কার্জন’ গেটের নাম। বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদের নামে তোরণের নাম রাখা হয় ‘বিজয় তোরণ’। এই শহরের প্রধান রাস্তার নাম হয় ‘বিজয় চাঁদ রোড’

বর্ধমান শহরের ‘সিগনেচার’ ‘বিজয় তোরণ’। ভারতের মানচিত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার ইতিহাসেও। ১৯৭৪ সাল থেকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনসম্পদ বিভাগ দ্বারা গেটটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কয়েক বছর আগে তোরণটি সংস্কার করা হয়। সময়ের ধারায় কিছুটা বদলে গেছে। কিন্তু বর্ধমান শহরের হারানো অতীত আজও কথা বলে এই সব স্মৃতি চিহ্নেই...

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...