ব্যালকনি বা ছাদবাগানে সহজ পদ্ধতিতে করুন চন্দ্রমল্লিকার চাষ

শীতকাল আসবে অথচ সেই সময় আমাদের ছাদ বা ব্যালকনি বাগান চন্দ্রমল্লিকার বাহারে সেজে উঠবে না, এটা যেন ঠিক ভাবা যায় না। চন্দ্রমল্লিকার প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই একটা দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতা তার অসাধারণ রূপ আর অনন্য বর্ণমালার জন্য। সারাটি শীত জুড়ে লাল, সাদা, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি প্রভৃতি নানান রঙের হালকা, গাঢ়, মেলানো-মেশানো অপরূপ সৌন্দর্যময় অঢেল ফুলে চন্দ্রমল্লিকারা আমাদের বাগান আলো করে রাখে। সেই সৌন্দর্য দেখে মনে হয়, এ-সময় শুধুমাত্র চন্দ্রমল্লিকা দিয়েই একটা বাগান যদি করা যায়, তাহলে আর অন্য কোন ফুল না-হলেও চলে।

তবে ছাদ বা ব্যালকনিতে যাঁরা বাগান করেন, যাঁরা খুব বেশি সময় গাছপালার পেছনে দিতে পারেন না, তাঁদের অনেকেই হয়তো সেই ভালোলাগা থেকেই চন্দ্রমল্লিকার চারা বসিয়েও চারা বাঁচাতে পারেননি কিংবা মনের মতো ফুল ফোটাতে পারেননি; আবার অনেকেই শুনেছেন যে, এর পেছনে পড়ে থেকে নাকি অনেক যত্নআত্তি করতে হয়, তবেই মনের মতো ফুল ফোটানো যায়! এই সব কারণে যাঁরা চন্দ্রমল্লিকা করতে ভয় পান, তাঁদের বলি, ভয় পাবেন না। বিশ্বাস করুন, চন্দ্রমল্লিকার চাষে ভয় পাবার কিছুই নেই। যাঁদের চন্দ্রমল্লিকা বাঁচেনি বা ফুল দেয়নি; সেটা সঠিক পরিচর্যা না-জানার জন্যই হয়েছে। সেই পরিচর্যা কিন্তু সামান্যই। তার জন্য বিশেষ কোন হ্যাপা পোয়াতে হয় না। অন্য আর-পাঁচটা গাছের ক্ষেত্রে তাদের স্বভাব-চরিত্র অনুযায়ী যেমন সামান্য সামান্য পরিচর্যার ফারাক দেখি, এক্ষেত্রেও সেটুকুই শুধু মাথায় রাখার, আর কিছু না। সেটুকু জেনে ফেললে খুব সহজেই চন্দ্রমল্লিকার চাষ করা যায়। বিশ্বাস করুন...

চন্দ্রমল্লিকার আকার ও বাহার অনুযায়ী আছে প্রচুর ভ্যারাইটি। ইংরিজি ও বাংলা মিলিয়ে সে নামের একটা লম্বা লিস্টি রয়েছে। আমরা তার ফিরিস্তিতে যাব না। বাংলার আপামর নার্সারি ও গাছবিক্রেতারাও যান না। তাঁরা নিজেদের বোঝার জন্য ও খদ্দেরকে বোঝানোর সুবিধের জন্য চন্দ্রমল্লিকাকে মোটামুটি দু’রকম ভ্যারাইটিতে বেঁধে নিয়েছেন। যথাঃ এক, ‘বল বা জায়ান্ট ভ্যারাইটি’; এবং দুই, ‘পমপন ভ্যারাইটি’। ‘বল বা জায়ান্ট ভ্যারাইটি’র চন্দ্রমল্লিকার ফুল বেশ বড় হয়, বিভিন্ন ডিজাইনের হয়, গাছও তুলনায় বেশ বড় হয় এবং এর প্রচুর যত্নআত্তিরও প্রয়োজন পড়ে। শীত পড়ব পড়ব এমন আবহেই এই ভ্যরাইটির গাছে ফুল এসে যায়। ‘পমপন ভ্যারাইটি’র ফুল ছোট ও মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। ফুল মাঝারি বা ছোট হলেও এর সৌন্দর্য কিন্তু একেবারেই কম নয়। রঙের সমাহার জায়ান্টের মতোই। সারা গাছ ঝেঁপে যখন ফুল ফোটে, মনে হয় যেন আস্ত ও অপূর্ব একখানা ফুলদানি বসানো আছে। এই ভ্যারাইটি সহজে ও সামান্য যত্নেই চাষ করা যায়। তাই এই ভ্যারাইটিই এবার শীতে আপনি চাষ করবেন। বাজারের গাছ বিক্রেতার কাছে চারা কিনতে গিয়ে তার মুখে ফুলের বিবরণ শুনে তাল ঠিক রাখা মুশকিল হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে আপনাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে শুধুমাত্র পমপন ভ্যারাইটির চারাই কিনে আনতে হবে।

বাজারে গিয়ে চেষ্টা করবেন পটের চারা কিনতে। না পেলে অবশ্য কিচ্ছু করার নেই শিকড়শুদ্ধু তোলা খুচরো চারাই কিনতে হবে। এই ধরণের চারা মাটি থেকে তোলা, বয়ে আনা, অন্য মাটিতে বসান—এই সব ধাপের ধকল পেরিয়ে চট করে বাঁচতে চায় না। এই ধরণের পরিস্থিতির জন্য বাগান করলে প্রস্তুত থাকতেই হয়। সেক্ষেত্রে দুটো জিনিস অবশ্যই অনলাইন বা নার্সারি থেকে কিনে নেবেন। এক, ‘এপসম সল্ট’; দুই, ‘রুট হরমোন’ পাউডার। এপসম সল্ট পাঁচশো গ্রামের প্যাকেট দুশো টাকার মধ্যেই পেয়ে যাবেন। আর রুট হরমোন পাউডার একশ গ্রামের কৌটো দেড়শ থেকে দুশো টাকা দাম পড়বে। এপসম সল্ট এক্কেবারে চিনির দানার মতো দেখতে। এক চা-চামচ এই দানা ও কোয়ার্টার চামচ রুট হরমোন আধ গ্লাস জলে গুলে তাতে চন্দ্রমল্লিকার তুলে আনা চারার কাণ্ড ও শেকড় ঘন্টাদুয়েক ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর টবে চারাটি লাগিয়ে ওই জলটা দিয়ে তাকে স্নান করিয়ে দিতে হবে। এই ট্রিটমেন্টের পর চারা মরার চান্স প্রায় থাকে না বললেই চলে।

চারা পটের হোক বা তোলা, তাকে প্রথম বার টবে যখন বসাবেন, তখন ছয় ইঞ্চি টবে বসাবেন। চন্দ্রমল্লিকা ঝুরঝুরে দোআঁশ মাটি ভালোবাসে। তাই তার জন্য তেমন মাটিই তৈরি করতে হবে। দু’ভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে এক ভাগ বালি আর এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট ভালো করে মেশালেই দোআঁশ মাটি তৈরি হয়ে যাবে। চন্দ্রমল্লিকার টবে জল যাতে একদম না-দাঁড়ায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। চারা বসানোর পর প্রায়ই দেখা যায় যে, ছত্রাকের আক্রমণে শিকড় পচে চারা মারা যায়। চারায় বেশি জল দেওয়া ও টবে জল জমা এই সমস্যার প্রধান কারণ। তাই টবের ভেতর প্রথমে খোলামকুচি টবের তলার ফুটোর ওপর বসাবেন। তার ওপর স্টোন চিপস বা কুচি পাথর এবং বালি দিয়ে ইঞ্চি তিনেকের একটি লেয়ার তৈরি করবেন। এর ওপর তৈরি করা দোআঁশ মাটি দিয়ে ছোট্ট গর্ত করে তাতে এক চিমটে সাফজাতীয় ফাঙ্গিসাইড বা এক মুঠো হলুদ গুঁড়ো দিয়ে চারাটি লাগিয়ে দেবেন। এতে গাছের গোড়ায় ছত্রাকের আক্রমণ হয়ে গাছ মরে যাবে না। এবার ভালো করে জল দিয়ে টবশুদ্ধ চারাটি এক সপ্তাহ রেখে দিন শেডের তলায়। চন্দ্রমল্লিকার চারার সব ধকল কাটিয়ে শেকড় দিয়ে মাটি ধরতে এই সময়টা লাগে। এই সময়ের পর তাকে চার-পাঁচ ঘন্টা রোদ আসে, এমন জায়গায় রেখে দিন। চন্দ্রমল্লিকায় নভেম্বরে কুঁড়ি ও ফুল আসতে শুরু করে। তাই নতুন চারা লাগানোর কাজ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে। এরপর যত দেরি করবেন, এ-বছর ফুল পাওয়ার আশা ততই কম হতে থাকবে।

যদিও এখন খাতায়-কলমে শরৎ এসে গেছে। তথাপি মাঝে মাঝেই নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে এবং টানা ক’দিন বৃষ্টি চলছে। দু’একদিনের বৃষ্টি ও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি চন্দ্রমল্লিকা সহ্য করে নেয়। টানাবৃষ্টি তার জন্য ক্ষতিকর। তাই তেমন পরিস্থিতি হলে সেই সময়টুকু টব সরিয়ে নিরাপদ শেডে রাখতে হবে, যেখানে বৃষ্টির জল সেভাবে পাবে না।

এবার আসি পরিচর্যার কথায়। চারা লাগানো বা বসানোর সময় থেকেই একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে যে, চন্দ্রমল্লিকার টবে অহেতুক জল দেওয়া যাবে না। টবের মাটি শুকোলে জল দেবেন, নচেৎ নয়। চারা বসানোর পর পনের দিন পর্যন্ত টবে গাছের জন্য কোন খাবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মাটি তৈরির সময় যে ভার্মি কম্পোস্ট মেশানো হয়েছে, তাতেই তার এই সময়টা বেশ ভালভাবেই চলে যাবে। খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে পনের দিন পর থেকে নিয়ম করে। সাত দিনে একবার সরষের খোল তিন দিন ধরে পচিয়ে, সেই পচা জল ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তার সঙ্গে আরও জল মিশিয়ে পাতলা করে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। বৃষ্টি হলে এই জল দেওয়া যাবে না। এই সময় খোল পচা জল গাছের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জন্ম দেয়। তাই এই সময় বিকল্প হিসেবে সবজি খোসা পনের দিন ধরে পচিয়ে সেই জল দেওয়া যাবে। এই জৈব সার প্রয়োগের তিন দিন পর গাছ প্রতি ডিএপি’র তিনটে দানা ও ইউরিয়ার পাঁচটি দানা গাছের গোড়া থেকে দূরে টবের ধার ঘেঁষে দিতে হবে। গাছে কুঁড়ি এলে যতদিন ফুল ফুটবে নিয়ম করে এর সঙ্গে পনের দিন অন্তর টবে দেড়-দু’মুঠো গোবর সার বা ভার্মি কম্পোস্ট সার দিতে হবে। এতে ফুল অনেক বেশি সতেজ হয়, আকারে-প্রকারে বেশ বড়ও হয়।

চারা লাগানোর পর আর একটা ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে গাছে ছ’পাতা হয়ে গেলেই ডগা টুক করে কেটে ফেলতে হবে। একে বলে ‘পিঞ্চিং’। এতে গাছে কয়েকটা নতুন শাখার জন্ম হবে। সেই শাখাগুলো এক আঙুল মতো লম্বা হলে তাদেরও শুধু ডগাটুকু কেটে ফেলতে হবে। এভাবেই একের পর এক নতুন শাখার জন্ম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কেননা, চন্দ্রমল্লিকার যত বেশি ডাল হবে, তত বেশি কুঁড়ি হবে, তত বেশি ফুল হবে। গ্রীষ্মের শেষ ও বর্ষার আগে গাছ লাগিয়ে এভাবে ঝাঁকড়া করে এক একটি গাছে হাজার থেকে দেড় হাজার অব্দি ফুল ফোটানো যায়। পিঞ্চিং করা যায় অক্টোবর মাস পর্যন্ত। নভেম্বর পড়লেই সেটা বন্ধ করতে হবে। কারণ, এই সময় কুঁড়ি আসা শুরু হবে গাছে।

চন্দ্রমল্লিকার গাছ গুল্ম প্রজাতির। তার কাণ্ড বেশ দুর্বল, শাখা-প্রশাখার ভার নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তাই গাছ যত বাড়তে থাকে, ডাল তত ছড়িয়ে চারপাশে এলিয়ে পড়তে থাকে। তাকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখার জন্য সাপোর্ট হিসেবে টবের মধ্যিখানে শক্ত বাখারি বা কাঠি পুঁতে গাছ তার সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনে টবের চারপাশে এক্সট্রা চারটি বাখারি বা কাঠি দিয়ে অগোছালো ডাল গুছিয়ে সুন্দর করে বেঁধে দিতে হবে।

চন্দ্রমল্লিকা গাছে সাদা মাছি ও জাবপোকারা খুব হানা দেয়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ইমিডাক্লোরোপিড গ্রুপের কীটনাশক প্রয়োগ করতেই পারেন। আর যদি ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে বিষ ঢোকাতে না-চান; তাহলে চন্দ্রমল্লিকার গাছের পাতার তলা সময় পেলেই একটু খেয়াল রাখবেন, সেখানে ছোট ছোট সাদা মাছির ডিম দেখতে পেলেই ঘষে নষ্ট করে দেবেন। আর জাব ধরলে সাবান জল পর পর দু’দিন স্প্রে করে দিলেই তারা দিব্য মরে যাবে। 

নভেম্বরের শেষ থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্রমল্লিকা ফুল দেয়। এই ফুল সহজে ঝরে না, চট করে মরে না। শীতের মরসুমে এই গাছ অপরূপ ফুলের সজ্জায় সেজে ওঠে, ফুলে ফুলে পাতা ঢেকে অপরূপ হয়ে ওঠে, সেই রূপের আলো থেকে চোখ ফেরানোই যায় না।

মার্চের মাঝামাঝি যখন গাছে ফুল আসা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন কিন্তু গাছ নষ্ট করবেন না। কারণ, এই গাছ বহুবর্ষজীবী। একে এই সময় থেকেই পরের বছরের জন্য তৈরি করার কাজ শুরু করে দিতে হবে। টবের ওপরে চার ইঞ্চি মতো কাণ্ড রেখে গাছ কেটে দিন। নিয়মিত জল ও খাবার দিতে থাকুন। কাটা কাণ্ড থেকে যে নতুন শাখা বেরুবে তাকে যত্ন করে বাড়তে দিন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে এই গাছের খুব কষ্ট হয়। তাই প্রখর তাপ থেকে বাঁচাতে অল্প রোদ আসে এমন জায়গায় টব সরিয়ে দিন। যদি সেটা সম্ভব না-হয়, তাহলে সকালে ও বিকেলে নিয়ম করে স্নান করিয়ে গাছে জল দিন। এতে সে অনেকটাই ভালো থাকবে।

গ্রীষ্ম শেষ হয়ে আসছে, বর্ষার সূচনা ঘটছে—এই রকম সময় ছ’ইঞ্চির টব থেকে গাছকে আট ইঞ্চি টবে ট্রান্সফার করতে হবে। ধকল সামলাতে এক সপ্তাহের শেড বিশ্রাম দিয়ে তারপর তার পিঞ্চিং শুরু করে দিতে হবে। যে ডালগুলো খুব বেড়ে গেছে এবং যে ডালগুলো বেয়াড়া হয়ে গাছের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, সেগুলো ছেঁটে দেবেন তার আগে। তবে সেগুলো ফেলে দেবেন না। সেগুলোর ডগার দিকে তিন থেকে চার ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ডাঁটিতে রুট হরমোন মাখিয়ে বালিতে পুঁতে দিয়ে প্রয়োজনমতো জল দিলেই তা থেকে দিন পনেরোর মধ্যে নতুন চারার জন্ম হবে। এভাবেই একটা গাছ থেকে বর্ষার মধ্যেই আপনি অনেকগুলো চারা তৈরি করে নিতে পারবেন।

এবার দেখলেন তো, চন্দ্রমল্লিকায় ফুল ফোটানো একেবারেই কঠিন কিছু না। আর-পাঁচটা মরসুমী ফুলের মতোই সহজ তার পরিচর্যা। এবং এর চাষে খরচও তেমন হয় না। তাহলে আর কী, দেরি না-করে আজকালের মধ্যেই চন্দ্রমল্লিকার চারা এনে যেভাবে বললাম সেভাবে লাগিয়ে ফেলুন, আর এই শীতে আপনার ছাদ বা ব্যালকনি বাগান ভরিয়ে তুলুন তার অপরূপ রূপে। ফুলের মরসুমে বাজারে আপনি ফুলফোটা অবস্থায় টবশুদ্ধ গাছও পাবেন, কিন্তু আদরে-যতনে ছোট থেকে একটা গাছ বড় করে তাতে ফুল ফোটানোর আনন্দই আলাদা তৃপ্তিই আলাদা, তাই না?...     

         

       

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...