শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর শেষ উপন্যাস ‘শেষের পরিচয়’ শেষ করে যেতে পারেননি। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এটি লিখতে লিখতে তিনি অসুস্থ হন এবং মারা যান। এই অসুস্থতার সময় তিনি বাংলার মুসলমানদের জীবন, অবস্থা ও সমাজের উপর একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু, সেই লেখাটিও লিখে যেতে পারেননি। গল্প-উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে শুরু থেকেই তিনি নন্দিত, নিন্দিতও হয়েছেন। তবে সবচেয়ে নিন্দিত ও বিতর্কিত হয়েছিলেন 'চরিত্রহীন' লেখার জন্য।
১৯১২ সালের কথা। শরৎচন্দ্র তখন রেঙ্গুনের বোটাটং ল্যান্সডাউন স্ট্রিটে একটা দোতলা কাঠের বাড়ির বাসিন্দা। ৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ তাঁর বাড়ির কাছাকাছি আগুন লাগল, বাড়িগুলো সব কাঠের হওয়ায় দাবানলের মতো আগুন ছড়াতে ছড়াতে অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর বাড়িতেও এসে লাগল। চোখের সামনেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সেই আগুনের কবল থেকে শরৎচন্দ্র সামান্য কিছু জিনিস বাঁচাতে পারলেও, তাঁর সৃষ্টির অনেক কিছুই হারাতে বাধ্য হলেন। খেদ হল সম্বল। সেই খেদের কথা ২২ মার্চের চিঠিতে জানালেন বাল্যবন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে : "আগুনে পুড়িয়াছে আমার সমস্তই। লাইব্রেরী এবং 'চরিত্রহীন' উপন্যাসের manuscript...৫০০ পাতায় প্রায় শেষ হইয়াছিল—সবই গেল।"
'চরিত্রহীন' শরৎচন্দ্রের সচেতনচিত্তের ব্যতিক্রম সৃষ্টি। উপন্যাসটি সম্পর্কে তাঁর গভীর প্রত্যয়ের পরিচয় এই সময়ে লেখা বিভিন্ন চিঠিতে আমরা পাই। তাই আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর 'চরিত্রহীন'-কে তিনি ভুলে যেতে পারলেন না। নতুন উদ্যমে আবার লিখতে শুরু করলেন। ১০ জানুয়ারি ১৯১৩, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে শরৎচন্দ্র জানাচ্ছেন : "চরিত্রহীন কবে সম্পূর্ণ হবে বলতে পারি না। প্রায় অর্দ্ধেকটা হয়েছে মাত্র।" মাঘ, ১৯১৩-তে "যমুনা"-পত্রিকার সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ পাল-কে লিখলেন : "চরিত্রহীন প্রায় সমাধার দিকে পৌঁছেচে। তবে সকাল ছাড়া রাত্রে আমি লিখতে পারি নে।"
চিঠিচাপাটির সূত্রে শরৎচন্দ্রের 'চরিত্রহীন'দাহের খবর যেমন বন্ধুমহলে সুদূর রেঙ্গুন থেকে এসেছিল, তেমনি এলো 'চরিত্রহীন' পুনর্লিখনের খবরও। কিন্তু, 'চরিত্রহীন' যে কী বস্তু, তা তখনও তাঁরা সম্যক বুঝলেন না। শরৎচন্দ্র লিখছেন মানে, ভালো কিছু একটা নিশ্চয়ই হবে। ব্যস, সম্পাদকবন্ধুরা তাঁকে ছেঁকে ধরলেন। লেখাটা প্রত্যেকেরই চাই! বন্ধুদের আবদার এড়ানোও মুশকিল।
তাই সেই আদ্দেক লেখাটি প্রথম পাঠালেন বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতির কাছে। তিনি 'সাহিত্য' পত্রিকার সম্পাদক। কিন্তু, লেখা হাতে পেয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত সমাজপতি সটান পিছিয়ে পিঠটান দিলেন। শরৎচন্দ্রের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন যে, উঁহু, এ-উপন্যাস তাঁর পক্ষে ছাপা সম্ভব নয়। কারণ? এ জিনিস ছাপলে পত্রিকার পাঠক পালিয়ে যাবে। মেসের ঝির সঙ্গে নায়কের প্রেম তারা কিছুতেই মেনে নেবে না! সুতরাং, পত্রপাঠ পাণ্ডুলিপি ফেরত পাঠালেন।
৩ মে ১৯১৩-য় ফণীন্দ্রনাথ পাল-কে লেখা চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে যে, সেই আধখানা পাণ্ডুলিপি বাধ্য হয়েই তিনি আবার বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে পাঠিয়েছেন। তখন নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে সম্পাদক করে 'ভারতবর্ষ' পত্রিকাটি বের করার প্রস্তুতি চলছে। প্রমথ এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
প্রথম সংখ্যা বেরুনোর অনেক আগেই ১৭ মে সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রলাল মারা গেলেন। তার কিছুদিন পর অবশ্য 'ভারতবর্ষ' বেরুল, কিন্তু, তাতে 'চরিত্রহীন' বেরুল না। ওদিকে ফণীন্দ্রনাথের 'যমুনা'-কে শরৎচন্দ্র অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখেন, পত্রিকাটি বড় করার স্বপ্নও দেখেন; তাই তাঁর একান্ত ইচ্ছে উপন্যাসটি 'যমুনা'-তেই প্রকাশ পাক। তাই শরৎচন্দ্র আটঘাট বাঁধতে চাইলেন। ফলে, তাঁর নির্দেশে পাণ্ডুলিপি না-পড়েই ফণীন্দ্রনাথ উপন্যাসটি যে শিগগির ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে 'যমুনা'-য়; সেই কথাটি জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলেন।
হুড়োহুড়ি করে বিজ্ঞাপন না-দিলেও চলত। কারণ, উপন্যাসটি প্রমথ বা ভারতবর্ষগোষ্ঠীর পছন্দ হল না। এতে 'যমুনা'-র শুভানুধ্যায়ী শরৎচন্দ্র হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, কিন্তু, স্রষ্টা শরৎচন্দ্র অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁদের আপত্তির কারণ, morality এবং মেসের ঝি'র নায়িকা হওয়া এবং তাকে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেওয়া! এ-বিষয়ে প্রমথকে লেখা জ্যৈষ্ঠ, ১৩২০'র চিঠিতে শরৎচন্দ্রের ঝাঁঝ ও বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট : "যা হোক তোমাদের যখন ওটা পছন্দ হয় নাই, তখন আমাকে ফেরত পাঠাইয়ো।
বিজ্ঞাপন যেমন দেওয়া হইয়াছে, সেই মত 'যমুনা'তেই ছাপা হইবে। ...আমি জানিতাম, ওটা তোমাদের পছন্দ হইবে না...তবে, এ সম্বন্ধে আমার এই একটু বলিবার আছে যে, যে লোক জানিয়া শুনিয়া 'মেসের ঝি'-কে আরম্ভেই টানিয়া আনিবার সাহস করে, সে জানিয়া শুনিয়াই করে।" এ প্রসঙ্গে ১০ মে ১৯১৩'র চিঠিতে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রমথ ও ভারতবর্ষগোষ্ঠী সম্পর্কে লিখলেন : "বোধ করি manuscript পড়িয়া কিছু ভয় পাইয়াছে।...শেষে হয়ত একদিন আপশোষ করিবে কি রত্নই হাতে পাইয়াও ত্যাগ করিয়াছে!"
'চরিত্রহীন'-এর ওপর শরৎচন্দ্রের যে অসম্ভব আস্থা ও আত্মবিশ্বাস—তার ওপর ভর করেই ফণীন্দ্রনাথ এগোচ্ছিলেন। কিন্তু, সেই তিনিও সম্পাদকদের ক্রমান্বয় নেতিবাচক মনোভাব দেখে পিছু হটতে চাইলেন, নিজের এবং পত্রিকার বদনামের ভয় পেলেন। এ ব্যাপারে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে ১০ মে ১৯১৩ শরৎচন্দ্র লিখলেন : "শুনিতেছি, ওটাতে 'মেসের ঝি' থাকাতে রুচি নিয়ে হয়ত একটু খিটিমিটি বাধিবে। বাধুক। লোকে যতই নিন্দা করুক না, যারা যত নিন্দা করিবে তারা তত বেশী পড়িবে। ওটা ভালো হোক মন্দ হোক একবার পড়িতে আরম্ভ করিলে পড়িতেই হইবে। যারা বোঝে না, যারা art-এর ধার ধারে না তারা হয়ত নিন্দা করবে।
কিন্তু, নিন্দা করলেও কায হবে। তবে ওটা psychology এবং analysis সম্বন্ধে যে খুব ভাল তাতে সন্দেহই নেই। এবং এটা একটা সম্পূর্ণ scientific ethnical novel! এখন টের পাওয়া যাচ্ছে না।" আবার ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯১৩-র চিঠি থেকে জানতে পারছি : "চরিত্রহীন মাত্র ১৪/১৫ চ্যাপ্টার লেখা আছে, বাকিটা অন্যান্য খাতায় বা ছেঁড়া কাগজে লেখা আছে, কপি করিতে হইবে। ইহার শেষ কয়েক চ্যাপ্টার যথার্থই grand করিব।
লোকে প্রথমটায় যা ইচ্ছা বলুক, কিন্তু শেষে তাহাদের মত পরিবর্তিত হইবেই। আমি মিথ্যা বড়াই করা ভালোবাসি না এবং নিজের ঠিক ওজন না বুঝিয়াও কথা বলি না, তাই বলিতেছি, শেষটা সত্যিই ভালো হইবে বলিয়াই মনে করি। আর moral হৌক immoral হৌক, লোকে যেন বলে, 'হ্যাঁ একটা লেখা বটে।' আর এতে আপনার বদনামের ভয় কি? বদনাম হয় ত আমার। তা ছাড়া কে বলিতেছে আমি গীতার টীকা করিতেছি? "চরিত্রহীন" এর নাম!--তখন পাঠককে তো পূর্ব্বাহ্নেই আভাস দিয়াছি--এটা সুনীতিসঞ্চারিণী সভার জন্যও নয়, স্কুলপাঠ্যও নয়!"
আশ্বস্ত বাক্যে কাজ হল। বাংলা ১৩২০ সালের কার্তিক সংখ্যার 'যমুনা'য় 'চরিত্রহীন'-এর প্রথম কিস্তি প্রকাশ পেল। ধারাবাহিক চলল ১৩২১ পর্যন্ত। তারপর হঠাৎ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। 'যমুনা' ও ফণীন্দ্রনাথ দুজনেই শরৎচন্দ্রের চোখের মণি ছিলেন। কিন্তু, ফণীন্দ্রনাথ মানুষটা ছাপোষা সন্দিগ্ধস্বভাবের লোক। এসময় 'ভারতবর্ষ'-এ শরৎচন্দ্রের দু'চারটে গল্প বেরুতেই তিনি শরৎচন্দ্রকে সন্দেহ করতে লাগলেন। ভাবলেন, শরৎ বোধহয় 'যমুনা' ছেড়ে চললেন 'ভারতবর্ষ'-এ! আর এই অহেতুক সীমা ছাড়াতেই শরৎচন্দ্র বিরক্ত হয়ে 'যমুনা'-য় লেখা একেবারেই বন্ধ করলেন। এমনকি, 'চরিত্রহীন'-ও শেষ করলেন না।
অবশ্য পত্রিকায় যেটুকু প্রকাশ পেল, তাতেই নীতিবাদীদের কেচ্ছা শুরু হল, 'গেল গেল' রব উঠল। সে-সময় সাহিত্য জগতে আর এক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব ঘটেছিল, সেই সুযোগে কথাশিল্পীর পরিচয় দিতে গিয়ে অনেকেই শরৎচন্দ্রকে 'চরিত্রহীন শরৎচন্দ্র' বলে তামাশা করতে শুরু করল। বলাবাহুল্য, 'চরিত্রহীন' দীর্ঘদিন পড়ে রইল, অন্যান্য বইগুলোর মতো রাতারাতি বই হয়ে বেরুল না। শরৎচন্দ্রের এযাবৎকালের বইয়ের প্রকাশকও এগিয়ে এলেন না। ভিক্টোরিয়ান ছাপোষা মানসিকতায় বদনামের ভয় ও সাহসের অভাবে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর 'মৌচাক'-পত্রিকার সম্পাদক সুধীর সরকার এগিয়ে এলেন। তাঁর এম.সি. সরকার এন্ড সন্স-প্রকাশনসংস্থা থেকে ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে 'চরিত্রহীন' প্রথম বই হয়ে বেরুল।
'চরিত্রহীন'-এর নিন্দুক যেমন ছিল, তেমনি গুণমুগ্ধ পাঠকও কম ছিল না। আর 'চরিত্রহীন'-সম্বন্ধে চিঠিতে লেখা শরৎচন্দ্রের আত্মপ্রত্যয় ও ভবিষ্যৎবাণী যে কতটা অমোঘ ছিল, তা বইটি প্রকাশ হতেই স্পষ্ট হয়ে গেল। 'মৌচাক' পত্রিকার সম্পাদক সুধীর সরকার জানিয়েছেন : "বেশ মনে আছে 'চরিত্রহীন' পড়িবার জন্য পাঠকদের যে আগ্রহ দেখিয়াছি, তাহা বোধ হয় কোন সাহিত্যিকের ভাগ্যে ঘটে নাই। 'চরিত্রহীন' পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইতে দুই বৎসর লাগিয়াছিল। যেদিন 'চরিত্রহীন' প্রথম প্রকাশিত হয়, সেই দিনই এই ৩৷৷০ মূল্যের উপন্যাসের ৪৫০ কপি বিক্রয় হইয়া যায়।"
তারপরেও বেনারসের এক সাহিত্যসভায় সভাপতিত্ব করতে গিয়ে শরৎচন্দ্রের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। সভার শেষে একটি বিধবা মেয়ে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করল। তাঁকে প্রণাম করে বলল যে, 'চরিত্রহীন'-এর কিরণময়ী তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। শরৎচন্দ্র একটু অবাক হলেন। কীভাবে? উত্তরে মেয়েটি জানাল তার জীবনের কথা। বলল যে, বিধবা হবার পর একটি ছেলের সঙ্গে তার প্রেম হয়েছিল। ঠিকও করে ফেলেছিল সমাজের বাধা অগ্রাহ্য করে দুজনে পালিয়ে বিয়ে করবে।
কিন্তু, ছেলেটির সঙ্গে অজানার পথে ভাসার আগে তার হাতে এল 'চরিত্রহীন'। উপন্যাসটি পড়ে কিরণময়ীর দূরবস্থা দেখে তার মোহ যেন কেটে গেল মুহূর্তে। সে সিদ্ধান্ত বদল করল। পরে বুঝেছিল, সিদ্ধান্ত বদল না-করলে তার জীবনটাও কিরণময়ীর মতো ভেসে যেত! মেয়েটির এই কাহিনি শুনে শরৎচন্দ্রের মুখে হাসি ফুটল। যাক, শত লোক তাঁর কুৎসা করলেও, তাঁর উপন্যাস অন্তত একজনের জীবন তো বাঁচিয়েছে - এতেই তিনি খুশি!