সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বধূ। সদ্য মা হয়েছেন। বিছানার ওপর বসে মাস ছয়েক বয়সের শিশুকন্যাকে বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ বাড়িতে পুলিশ। হাতে সমন। সমন মহিলার বিরুদ্ধেই। অভিযোগ তিনি অশ্লীল গল্প লিখেছেন।
সই করে সমন গ্রহণ করতে হবে। বেখেয়ালে সেই মহিলা বাচ্চার দুধের বোতলটা ধরিয়ে দিলেন পুলিশ কর্তার হাতে। পুলিশ কর্তার কলমটি তাঁর হাতে। সেই কলমেই সই করবেন।
ঘটনা অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু অভিঘাত প্রবল। আকস্মিকতায় চমকে গিয়েছিলেন সকলেই।
মহিলার নাম ইসমত চুঘতাই। ভারতের উর্দু কথা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ।
‘লিহাফ’ গল্পের জন্য অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হন। উক্ত ঘটনাটি সে সময়ের গল্প।
নিজের আত্মজীবনীতে ‘কাগাজী হেয় পেয়রাহান’ এভাবেই লিখেছেন ইসমত। নিজের লেখা প্রসঙ্গে বলতেন, "আমি লিখি খুব সাধারণ ভাষায়, যে ভাষায় আমি কথা বলি, সাহিত্যিক ভাষায় নয়।"
ইসমত চুঘতাইকে চার বছর মামলা লড়তে হয়েছিল। লাহোর হাইকোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন। পরে সেই মামলা থেকে নিষ্কৃতি পান তিনি।
একরোখা ও জেদী স্বভাব তাঁকে লেখিকা হিসেবে অন্যমাত্রা দিয়েছিল। উর্দু সাহিত্যে প্রথম নারীবাদী লেখিকা তিনি। পুরুষপ্রধান সাহিত্যের দুনিয়ায় একক বিপ্লবী নারীবাদী স্বর। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী কন্ঠ। রাজেন্দ্র সিং বেদী, সাদত হাসান মান্টো এবং কৃষণ চন্দর এর মতো লেখকদের মধ্যে নিজস্ব সত্ত্বা, শৈলী , ভাষা ও চিন্তা উপস্থাপন করেছেন।
জন্ম ইসমতের উত্তরপ্রদেশের বাদায়ুনে। বড় হওয়া ওঠা যোধপুরে। দশ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই নবম। বাবা সিভিল সার্ভেন্ট। বাবার কাজের সূত্রেই যোধপুর, আগ্রায় ঘুরতে হত। দিদিদের বিয়ে হয়েছিল তাড়াতাড়ি। ইসমত বেড়ে উঠেছিলেন দাদা- ভাইদের সঙ্গে। ইসমত চুঘতাই সবসময় স্বীকার করতেন তার বড় ভাই মির্জা আজিম বেগ চুঘতাই তার লেখিকা হয়ে ওঠার পেছনে প্রথম শিক্ষক। আজিম বেগ চুঘতাই ছিলেন সে কালের খ্যাতনামা উর্দু লেখকদের অন্যতম।
নিজের পরিবারের অনেক সদস্য উঠে এসেছিল তাঁর সাহিত্যে। রিয়েলস্টিক ভঙ্গীতেই।
চল্লিশের দশকে তাঁর গল্পে সমাজের এমন দিন উঠে এসেছিল যা সেই সময়ের নিরিখে নিঃসন্দেহে বড় বিপ্লব বলা যায়। মেয়েদের মনের জটিল পরিসর যা সাধারনত সমাজ এড়িয়ে যেতে বা অস্বীকার করতে অভ্যস্ত ইসমতের গল্পে উঠে আসত সেই সব বিষয়।
তিনি বলতেন, “কলমের হাতে আমি অসহায়। আমার মন ও কলমের মাঝে কেউ দাঁড়াতে পারে না।”
তাই লেখা যতই বিতর্কের জন্ম দিক, যতই সমাজের রোষানলে পড়ুক তিনি নিজের পথ বদলাননি কখনই। কলমের কাছে সৎ থেকেছেন আজীবন। পরিস্থিতির চাপে কখনও-সখনও বিরক্ত হয়েছেন, হতাশা গ্রাস করেছে, কিন্তু চুপ থাকেননি। সাহসী এবং ব্যতিক্রমী সত্ত্বাকে হারাতে দেননি।
লেখক সাদাত হুসেন মান্টো ছিলেন ইসমতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইসমতের মতই মান্টোর লেখাও অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতের কোপে পড়ে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ইসমত বলেন, ‘সমাজে বাজে জিনিসের অস্তিত্ব আছে দেখেই মান্টো তা লিখেছেন।’
ইসমত লিখতেন নিজের মনমেজাজ, খেয়াল অনুযায়ী। নিছক লিখতে হবে বলে লেখা নয়, ভিতর থেকে যখন লেখা উঠে এসেছে তখনই তিনি কাগজ-কলমের কাছে ধরা দিয়েছেন।
আলিগড় বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে বি এড শেষ করে একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন।
প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৯-এ। ছোটগল্প দিয়ে শুরু। ছায়াছবির জন্য কাহিনী লিখেছিলেন। সিনেমা থেকে শুরু করে মঞ্চ, রেডিয়ো নাটক, পরে ছবিতেও দেখা গিয়েছিল। বিয়ে করেছিলেন চল্লিশের দশকের নামী প্রযোজক শহিদ লতিফকে। ‘প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশ’এ তাঁদের আলাপ।
১৯৯১ সালে ইসমতের মৃত্যু হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল কবর নয়, তাঁকে যেন দাহ করা হয়। তাঁর পরিবার, কাছের মানুষরা তাই করেছিলেন।
ইসমত সম্পর্কে সাদাত হুসেন মান্টো একবার দ্য অ্যানুয়্যাল অব উর্দু স্টাডিজ’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, “কেউ তাকে ভালবাসবে, কেউ অপছন্দ করবে। কিন্তু তার সৃষ্টি সেই সব খারাপ ভাল অনুভূতির অনেক ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো কি মন্দ, খোলামেলা কি ঢাকা, যাই হোক না কেন তা মানতেই হবে। এছাড়া উপায় নেই। ”