নিশ্চিন্তে শেষ

আমাদের স্বাধীন দেশের নেতারা ভারতকে দেখতে চেয়েছিলেন বিশ্বের মধ্যে একটি দৃষ্টান্তমূলক দেশ হিসেবে। ২০০ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে থাকার পর কিভাবে ভারত স্বাবলম্বী হয়ে সকল মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে সবার সাথে মিলেমিশে দেশ চালায় তা যেন বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে,  সেটাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। যেই লক্ষ্যে সামিল হয়ে গঠিত হয়েছিল বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান। যেখানে বেশ কিছু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ভারতীয় নাগরিক পেয়েছিল প্রচুর স্বাধীনতা। ছিল সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা। কারন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকেই আমরা জানতে পারি, এই দেশে প্রচুর পর্যটক তথা বিদেশিদের আগমন ঘটেছিল। যাঁরা ভারতের সংস্কৃতি নিজেদের করে নেবার পাশাপাশি, তাদের সংস্কৃতিকেও আমাদের ভারতবাসীর মনে গেঁথে দিয়েছিল। সেই সূত্রেই ভারত 'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে' দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। আমরা ছোটবেলায় এই বিষয়ে রচনা যেমন পড়েছি, তেমনি, ইতিহাসের একটি প্রশ্নও  থাকত এই বিষয়কে কেন্দ্র করে। যে যত গুছিয়ে লিখতে পারত, সে তত বেশি নম্বর পেত।

    কিন্তু দিনে দিনে আমাদের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে লাগলাম কেমন যেন হাঁ- করা একটা সংস্কৃতি গ্রাস করে আমাদের ঐতিহ্যকে। বিপ্লব, প্রতিবাদ তো থাকবেই। কিন্তু শিক্ষিত বিপ্লবী আমরা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যেতে দেখলাম। বিপ্লবী মানেই যেন পেটোবাজ হতে হবে। দমাদ্দম গুন্ডামি করতে হবে। যাকে- তাকে (বয়সের গুরুত্ব না দিয়ে) যা ইচ্ছা তাই বলে গালিগালাজ করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চোখের সামনে দেখলাম নিম্নমানের হয়ে পড়ছে। ছোটবেযায় জেঠু-বাবা-কাকুরা যখন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করত, কিছুই বুঝতাম না, শুধু ভাবতাম না জানি গুরুগম্ভীর কি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু যখন রাজনীতি বুঝতে শুরু করলাম, ততদিনে তাতে লোনাজল ঢুকে গেছে। তাই রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছিলাম সেই সময়ে। আরও পরে যখন কাজের জগতে প্রবেশ করলাম, তখন কাজের তাগিদেই এই বিষয় নিয়ে শুনতে এবং তা নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, কোথাও তেমন কোনো আশার আলো কিছুতেই যেন দেখা যাচ্ছিল না। সদর্থক চিন্তার মানুষ আমি, সব কিছুকেই সদর্থক ভাবনা দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। ভাবি, ঠিক আছে, দেখাই যাক না, পরিস্থিতি বদলায় কি না। আমি মনে করি, যাঁরা দলীয় পতাকার নিচে আছেন তাঁরাই কেবলমাত্র দলকে আগলে রাখবেন। সেটাই কাম্য। কিন্তু যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ আমাদের, তাই সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য, রাজ্য সরকারই হোক বা কেন্দ্রীয় সরকার, যদি আমাদের সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ করার মত সঙ্গতি না থাকে, তাহলে অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। সেটাই সঠিক গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের কর্তব্য। সেভাবেই অবাধ ভোটপর্ব হওয়া উচিত। গতকাল শেষ হওয়া সাধারণ লোকসভা  নির্বাচনের প্রথম থেকেই অর্থাৎ প্রচার পর্ব থেকেই যে সব খবর শুনছি,  এবং দেখছিলাম তাতে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা বা আস্থা কোনওটাই নজরে পড়ছিল না। কোনোও  দল শালীনতার লেশমাত্র রেখে তাদের প্রচার পর্ব চালাননি। তাই আঙুল তুলে কোনও একটি দলকে দোষারোপ করা যাবেনা। এখনকার রাজনীতিটাই এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের যে দাঁত বার করা রাজনৈতিক দৈন্যতার চেহারা দেখা গিয়েছিল, এবারে সেখান থেকে কিছুটা হলেও উন্নীত হয়েছে রাজনীতি। পঞ্চম দফার নির্বাচন বাদে বাকি সব কটা দফাতেই কম-বেশি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া তেমন অশান্তি কোথাও হয়নি। বিশেষ করে ভোটাররা ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এটা একটা ভালো দিক।

    অন্যান্য বার ভোটের দিন আমি নিজেই ভোট দিতে যাওয়া ছাড়া পারতপক্ষে বেরোইনা। কিন্তু গতকাল শেষ দফার নির্বাচনে নিজের ভোট দেওয়ার পাশাপাশি একটি কাজ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। বেহালা থেকে রবীন্দ্র সদন চত্বর। চারিদিক শুনশান ছুটির দিনের চেহারা। কোথাও একটুও গোলমালের লেশমাত্র দেখলাম না। টুকটাক বিশৃঙ্খলা হয়ত ছিল, কিন্তু কোথাও তা মাত্রা ছাড়ায়নি। ফেরার সময় রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় অনেকেই অধৈর্য্য হয়ে উঠছিলেন। টালিগঞ্জ অটোর লাইনে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরও দেখছি অটোর দেখা নেই। দুটো অটো যাও বা এলো, তারা শুধুমাত্র হার্ড মেটাল বা শীতলা  মন্দির অব্দিই যাবে বললো। ভালো লাগলো এটা দেখে, যখন জিজ্ঞাসা করলাম, “ চৌরাস্তা যাচ্ছনা কেন তোমরা”? একটুও রাগ না দেখিয়েই বলল, দিদি, "ওখান থেকে একটাও প্যাসেঞ্জার নেই। কি করব বলুন ওই অব্দি গিয়ে”। বললাম, "কেউ যাবেনা"? উত্তর পেলাম, "কেনা যাবেনা? নিশ্চয়ই যাবে।" যদিও আমি একটু পরেই বাস পেয়ে যাওয়াতে তাতেই ফিরলাম, তবু ওই যে সান্ত্বনা দেবার ভাষা, সেটাই তো এখন উঠে গেছে। যা সেই মুহূর্তে আমার মত আরো যাত্রীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। তাই পরিশেষে এটুকুই বলার, আমরা কি আর একটু সহনশীল রাজনীবিদ দেখতে পাবনা, সুদূর ভবিষ্যতে? যারা শুধুই ভোট ব্যাংকের কথা ভেবে যথেচ্ছভাবে ভোট প্রচার না করে একটু শালীনতার সীমার মধ্যে থেকে ভোটের প্রচার করবেন। রাজ্য বা দেশ চালানোর কথা বাদই দিলাম। সেই পর্যায়ের সংযম মেনে চলবেন রাজনীতিবিদরা কবে তা ঠিক নেই। কিন্তু নির্বাচনে নিজেদের জিততে হবেই যেন-তেন প্রকারেণ-তাই চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব করে মাইক লাগিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলা আশা করি বন্ধ হবে অদূর ভবিষ্যতে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...