"রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী" দেবী দুর্গার দুই মেয়ে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। পুরাণ ও বিভিন্ন শাস্ত্রে এঁদের দু'জনকে নিয়ে নানা ব্যাখ্যা থাকলেও বাঙালির কাছে শারদীয়ার চারটে দিন তাঁরা দুর্গার মেয়ে হয়ে যায়। মা দুর্গার সঙ্গে চার ভাই-বোন মিলে মায়ের বাপের বাড়িতে উপস্থিত হয়। শুধু তাই নয়, সঙ্গে নিজেদের বাহনদেরও নিয়ে আসে। সরস্বতীর সঙ্গে হাঁস আর লক্ষ্মীর সঙ্গে প্যাঁচাও হাজির হয়।
"বাহন" অর্থে বহন করা। যাতে করে বহন করা যায় বা যাতায়াত করা যায়। অতীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় এই বাহনদের সাহায্যে সম্ভবত যাতায়াত করা হতো। তবে দেব-দেবীদের বাহন নিয়ে নানারকমের অর্থ ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দেবী সরস্বতী এবং দেবী লক্ষ্মীর বাহন নিয়ে নানান কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।
"ওঁ জয় জয়দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত
মুক্তাহারে। বীনা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী
দেবী। নম হস্তুতে"।
মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমীতে বাঙালি দেবী সরস্বতীকে এইভাবেই বন্দনা করে থাকে। তিনি বিদ্যার দেবী। সাধনার দেবী। তিনি যেমন শ্বেত শুভ্রবসনা তেমনি তাঁর বাহন রাজহাঁসও শ্বেতশুভ্র। রাজহাঁসের বুদ্ধিমত্তা ও জহুরির চোখ সম্ভবত মন জয় করে নিয়েছিল দেবী সরস্বতীর।
সংস্কৃতিতে সরস্বতী বহুমাত্রিক দেবী হিসেবে পরিচিত এবং তাঁর বাহন হাঁস। কথিত আছে, শ্বেতশুভ্র হাঁসের সামনে একটি পাত্রে যদি জলের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে রাখা হয়, তাহলে সে মিশ্রণ থেকে শুধুমাত্র দুধ পান করে। রাজহাঁস জলে ভেসে থাকলেও তার ডানা জলে ভেজে না। জল লাগলেও তা ঝেড়ে ফেলে দেয়। বিদ্যা আসক্তি মুক্ত হতে শেখায়। তাই বিশুদ্ধ জ্ঞানের বাহন হিসেবে সরস্বতীর বাহন হাঁস।
পশ্চিম ভারতের কোথাও কোথাও সরস্বতীর বাহন হিসেবে ময়ূরের উপস্থিতি লক্ষ্মণীয়। "পদ্মপুরাণ", "ব্রহ্মবৈর্তপুরাণ", "শিবপুরাণ", "ঋগ্বেদ" পরবর্তী হিন্দু শাস্ত্রে সরস্বতীর বাহনের উল্লেখ পাওয়া যায় না। "মৎস্যপুরাণ" অনুসারে পরমাত্মার মুখ নিঃসৃত শক্তিগুলোর মধ্যে সরস্বতী সর্বশ্রেষ্ঠা।
তিনি রূপের দেবীর ন্যায় পরমাসুন্দরী। মহাশ্বেতা এবং বীণাবাদিনী। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। ব্রহ্মার দৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরস্বতী তাঁর দৃষ্টির আড়ালে সরে যেতে থাকেন। কিন্তু ব্রহ্মা সেই দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং একটি করে মুখের সৃষ্টি হয়। এইভাবে ব্রহ্মার পাঁচটি মুখের জন্ম হয়।
ব্রহ্মার থেকে বাঁচার জন্য সরস্বতী রাজহংসীর রূপ ধারণ করে বনে লুকিয়ে পড়েন। ব্রহ্মা সেখানেও উপস্থিত হন। তিনি রাজহাঁসের রূপ ধারণ করে সরস্বতীর সঙ্গে মিলিত হন। সরস্বতীর এই ছদ্মরূপই পরবর্তীকালে বাহন হিসেবে তাঁর পদতলে স্থান পেয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
"এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে"।
কোজাগরী পূর্ণিমায় এই বন্দনা করেই আপামর বাঙালি তাঁর আরাধনা করে। ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী। সুখ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী। তিনি নাকি বড়োই চঞ্চল। তাঁকে খুব যত্ন করে ঘরে রাখতে হয়। তা নাহলে তিনি ঘর অন্ধকার করে চলে যান। তাই তাঁর এতো বন্দনা। এই দেবীর বাহন হল প্যাঁচা। তিনি লক্ষ্মী প্যাঁচা নামেও পরিচিত।
দুধ সাদা ছোট্ট হল প্যাঁচা। তিনিও সৌভাগ্যের প্রতীক। শিকারি পাখি প্যাঁচা যখন ওড়ে তখন বাতাস একদম কাঁপে না। ফলে শিকার টের পায় না। সম্পদ আহরণ করতে হয় নিঃশব্দে। তা রক্ষাও করতে হয় অতন্দ্রভাবে। নিশাচর প্যাঁচা তাই হয়তো দেবীর বাহন।
সমুদ্র মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মীর কথা রয়েছে। সমুদ্র মন্থনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় কোথাও লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে প্যাঁচার উল্লেখ নেই। হাতি, হরিণ, সারস, হাঁস এমনকি সিংহকে লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে তাঁর পদতলে দেখা যায়।
গ্রিক কাহিনি অনুযায়ী দেবী এথেনার বাহন প্যাঁচা। দেবী এথেনা হলেন জ্ঞানের প্রতীক। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন, আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় তাঁদের হাত ধরে গ্রিক সভ্যতার জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত প্যাঁচা ভারতে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে ধন ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে চিহ্নিত হয়। কারো করোর মতে গরুড় লক্ষ্মীর বাহন ছিল। পরে গরুড়ের ক্ষুদ্ররূপ হিসেবে প্যাঁচার আবির্ভাব হয়।
সরস্বতী আর লক্ষ্মী এই বাহনে চেপেই মা দুর্গার সঙ্গে মর্তে এসে ঘুরে যান।