ধর্মীয় সম্প্রীতি ও লৌকিক ঈশ্বরের জন্ম

বাংলার লোকায়ত দর্শনে ধর্মের মেলবন্ধন ঘটেছে। জন্ম হয়েছে দেবতার। তেমনই দেবতাদের কথা জানব আজ। ক্যানিং থানা এলাকায় ঘুটিয়ারি শরিফে বড়খাঁ গাজির কবর রয়েছে বলে ভক্তরা বিশ্বাস করেন। সেখানে যাঁরা তীর্থ করতে যান, তাঁদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। অবশ্য কিছু লোক বলেন বড়খাঁ গাজির কবর এখানে নয়, সেই করব রয়েছে বাংলাদেশের সিলেটে শিবগাঁও বা গাজিপুর গ্রামে। বাংলাদেশে পিরে পটও দেখা যায়।

এপার বাংলার গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়েই এই পির সাহেবের বেশ কিছু দরগা-নজরগাহ রয়েছে। নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা নির্বিশেষে ভক্তেরা ঘুটিযারি শরিফে দূরদূরান্ত জানা এসে হাজির হন। মনে করা হয়, ৭ আষাঢ় গাজি পিরের মৃত্যুদিন। প্রত্যেক বছর এই দিন থেকে টানা এক সপ্তাহ ঘুটিয়ারি শরিফে উৎসব এবং মেলা চলে। এই দিনগুলোতে জিয়ারতের সময়ে বারুইপুরের রায়চৌধুরী জমিদারবাড়ি থেকে আনা হয় শিরনি, বাতি-আতর। এগুলোই প্রথমে উৎসর্গ করা হয়। শোনা যায়, গাজি পির রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন রায়কে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর খাজনা আদায়ের জুলুম থেকে রক্ষা করেছিলেন। এখানে পিরোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন রায়চৌধুরী জমিদারেরা। 

হিন্দু-মুসলিমের নমস্য সুন্দরবনের বড়খাঁ গাজি আদপে কে?

জনশ্রুতি রয়েছে বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে এক পিরের যুদ্ধ লেগেছিল। কৃষ্ণরাম দাসের 'রায়মঙ্গল' কাব্য অনুযায়ী, ঈশ্বর এই যুদ্ধ থামানোর জন্য অর্ধেক হিন্দু অর্ধেক মুসলমান দেবতা কৃষ্ণপয়গম্বরের রূপ নিলেন। বিচিত্র তাঁর রূপ –

"অর্দ্ধেক মাথায় কালা একভাগা চুড়া টালা,

বনমালা ছিলিমিলী তাতে।

ধবল অর্দ্ধেক কায় অর্দ্ধ নীলমেঘ প্রায়

কোরান পুরাণ দুই হাতে।"

গাজি এবং দক্ষিণ রায়কে শান্ত করলেন তিনি। যুদ্ধ থামল। শর্ত হল গোটা সুন্দরবনেই গাজি পির শ্রদ্ধা এবং সম্মান লাভ করবেন। গাজিমঙ্গল বা গাজির গানে অবশ্য রয়েছে, গাজি সাহেবের কাছে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়েছিলেন। আবার, আব্দুল গফুরের 'কালু গাজী ও চম্পাবতী' কাব্যে পাওয়া যায়, সমস্ত হিন্দু দেবদেবী হয়ে উঠেছে গাজি পিরের বন্ধু এবং পরম আত্মীয়।

গাজি পির সাহেবের পুরো নাম মোবারক শাহ গাজি বা বড়খাঁ গাজি। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষেরা বিশ্বাস করেন, সুন্দরবন অঞ্চলের বেলে আদমপুর অথবা বৈরাটনগর গ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবার ছিল প্রচুর ধনসম্পত্তি, কিন্তু সেসবের মায়া ত্যাগ করে অল্প বয়সেই ফকিরের জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন যশোরের ব্রাহ্মণনগরের হিন্দু রাজা মুকুট রায়ের মেয়ে চম্পাবতীকে।

অনেকে বলেন, বড়খাঁ গাজি কারও ব্যক্তিগত নাম নয়, বাংলায় যে মহান ফকির-দরবেশরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তাঁরাই এই নামে পরিচিতি পেয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন, পঞ্চদশ শতকের পির ইসমাইল গাজিই হলেন বড়খাঁ গাজি। এই গাজি পির আসলে পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত পির জাফর খাঁ গাজির ছেলে। সুকুমার সেন মনে করেন, চতুর্দশ শতকের সুফি খান পরবর্তীতে বড়খাঁ গাজি নামে পরিচিত হন। 

সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ আজও বিশ্বাস করেন, বড়খাঁ গাজির অলৌকিক শক্তি রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার খাড়িগ্রামে পুরোনো দিনের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। সেখানে নারায়ণী মূর্তির পাশে ছিল ঘোড়ার পিঠে বসা এই বড়খাঁ গাজির মূর্তি। তাঁর মাথায় টুপি, মুখে লম্বা দাঁড়ি। পরে আছেন পায়জামা-চোগাচাপকান-পিরান। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু মানুষ বড়খাঁ গাজির ভক্ত।

সময়টা তখন খুব সম্ভব ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে। সুন্দরবন অঞ্চলে তখন চারজনের নাম উঠে এসেছে আর্থ-সামাজিক কেন্দ্রবিন্দুতে। এরা হলেন দক্ষিণ রায়, ধনাই বণিক, মনাই বণিক ও বড় খাঁ গাজী। প্রথম জন দক্ষিণ রায়, একদা তিনি রক্ত-মাংসের মানুষই ছিলেন, পরবর্তীকালে লোকদেবতার পরিণত হন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন হলেন ধনাই বণিক ও মনাই বণিক। সুন্দরবন এলাকার মাছ, কাঠ ও মধুর ব্যবসায় এরা দুজন ছিলেন সবথেকে বড়ো ও ধনী ব্যাবসায়ী।

চতুর্থ জন হলেন 'বড় খাঁ গাজী'। ইসালামধর্মের প্রচারক এই যোদ্ধার পরিচয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন, হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার পীর জাফর খাঁ গাজীর ছেলে এই বড় খাঁ গাজী, আবার কেউ বলেন পীর সুফি খান। মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের শীর্ষ ব‍্যক্তিরাই "বড় খাঁ গাজী" নামে পরিচিত হন। ইসলামধর্মের প্রচারক এই গাজীও কিন্তু বাঘের দেবতা! গাজীর চেহারার বর্ণনা প্রায় দক্ষিণ রায়ের মতোই। পায়জামা, চোগাচাপকান, পিরাণ পরিহিত এক ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা। কিছু অঞ্চলে এনাকেও কিন্তু লোকদেবতা হিসেবে পুজো করা হয়। তবে গাজীরা ধর্ম প্রচারক ছিলেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই! কারণ সোনা গাজী থেকে কলকাতার সোনাগাছির নাম হয়েছে, তিনিও ইসলাম ধর্ম প্রচার করতেই এদেশে এসেছিলেন।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় আরও এক গাজীর কথা জানা যায়, জেলা প্রান্তিক গ্রাম তাজপুর। গ্রামটি খুবই ছোট। অধিবাসীদের মধ্যে এক ঘর ব্রাহ্মণ ছাড়া সবাই জেলে বা বাগদি সম্প্রদায়ের। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশা মাছ ধরা আর চাষবাস। এমন একটি গ্রামের মানুষ, আপদে বিপদে একজন লৌকিক দেবতাকে ডাকেন। তিনি হলেন বাবা বামনগাজী। কারণ এই তাজপুর গ্রামেই অবস্থিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক প্রসিদ্ধ ও বিস্ময়কর দেবতা 'বামনগাজী'। যে নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সনাতন হিন্দুধর্ম ও ইসলামের এক বিস্ময়কর সহাবস্থান।

বাংলায় তখন ভক্তিবাদী আন্দোলনের জোয়ার, নাম-সংকীর্তনে ভেসে যাচ্ছে বাংলা। সুফিবাদের অন্তরের পবিত্রতা জাগানোর কথা বলা হচ্ছে। ভাবনা ও দর্শনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হিন্দু ও মুসলমান। ক্যানিং অঞ্চলের এক গ্রামে দরবেশ কামাল হোসেন প্রতিষ্ঠা করলেন 'খানকা'। সুফি, পীর, দরবেশগণ যে স্থানে তাসাউফের পাঠদান করেন, তাকে বলা হয় 'খানকা শরীফ'। কাকতালীয় ভাবে সেখানে কামাল হোসেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল পরম বৈষ্ণব বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের। দুজনেই ধর্মের বাহ্যিক অনুষ্ঠানের বিরোধী। কামাল হোসেনের জলপড়া ও বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেলপড়া মিলে নাকি স্থানীয় জনগণের রোগ নিরাময় করতে শুরু করেছিল। ফলে, এই দুটি মানুষের নাম দ্রুত  ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। প্রচুর মানুষ আসতে লাগলেন তাঁদের কাছে। ধীরে ধীরে ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগল। এই ভাবেই দুই বন্ধু একত্রে কাটিয়ে গেলেন তাঁদের জীবন। তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের এক ভক্ত অক্ষয় বন্দ্যোপাধ্যায়, তাজপুরে এসে বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভক্তিবাদ ও সুফিবাদের বাণী প্রচার করতে শুরু করলেন। তাজপুরেই প্রতিষ্ঠা করলেন অশ্বারোহী লৌকিক দেবতা বামনগাজীর বিগ্রহ। গাজীবাবার মন্দিরে একই সঙ্গে শুরু হল হরিনাম সংকীর্তন ও ভক্তদের মধ্যে তেলপড়া-জলপড়ার বিতরণ। বামনগাজী সাহেবের কাছে মানত করতে আসেন হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই।

গাজীবাবার মন্দিরের ভেতরে, ঘোড়ার ওপর বসে আছেন ঘনকালো শুশ্রু বিশিষ্ট, সুদর্শণ ও সুঠাম দেহী বামনগাজী সাহেব। গায়ে রয়েছে পৈতা। তাই নাকি তাঁর নাম হয়েগেছে বামুনগাজী। এই লোকদেবতার মধ্যে লুকিয়ে আছেন দরবেশ কামাল হোসেন আর বৈষ্ণব বিজয় বন্দোপাধ্যায়। তাঁদের ভক্ত অক্ষয় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দুই গুরুকে একই বিগ্রহে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বামনগাজী রোগব্যাধির দেবতা। এঁর দরবারে রোগ নিরাময়ের জন্য মানত করলে রোগ সারে। এমনকী ভক্তদের বিশ্বাস, মন্দিরের উঠানের ধুলো গায়ে মাখলেও রোগ সারে। বাবা বামনগাজীর প্রসাদ হল চিনি, সন্দেশ ও বাতাসা। বিগ্রহের সামনে হরিসংকীর্তন হয়। পুজো দেওয়ার আগে একজন নাপিত হাতের নখ কেটে দেন। তারপর স্নান করে মন্দিরে পুজা দিতে হয়। অসুস্থ ভক্ত মন্দিরের ধুলো মেখে নাকি সুস্থ হয়ে যান। এরপর মন্দির থেকে তেলপড়া নিয়ে গোয়ালঘর কিংবা ঠাকুর ঘরে রাখতে হয়। প্রত্যেকদিন এই মন্ত্রপূত তেলের ব্যবহারে নাকি সম্পূর্ণ রোগ নিরাময় হয়।

বাবা বামনগাজীকে নিয়ে একটি লোকছড়া রয়েছে,

সর্বচিন্তা পরিহরি  বামনগাজীরে স্মরি

নিয়মিত জলপড়া করহ সেবন,

অচিরে জানিবে তবে 

কোনও রোগ নাহি রবে

বামনগাজী বাবার পুজোয় মন্ত্রের ব্যবহার হত না, কিন্তু হালে মন্ত্রচ্চারণ করেই পূজাপাঠ চলে। গন্ডীদান প্রথা, মন্দিরে ঢিল বেঁধে মানতের প্রথা আজও রয়েছে। নিত্যপুজা হলেও ভিড় বারে শনি মঙ্গলবার। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মনোস্কামনা পূরণের পর ঢাক ঢোল বাজিয়ে বাবার দরবারে পুজো দিতে আসেন স্থানীয় ও দূরদূরান্তের মানুষ। চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে মন্দির প্রাঙ্গনে বিশাল ভক্তসমাগম হয় এবং মেলাও বসে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...