এ-যেন রামজন্মের আগেই লেখা 'রামায়ণ'! যেন আশ্চর্য সমাপতনে ফলে যাওয়া কোষ্ঠীলেখা ভবিষ্যত! 'যা' নিয়ে ভণিতা করলাম, সেটি আসলে একটি গল্প, মনীন্দ্রলাল বসু'র লেখা, 'সুকান্ত'। আর 'যাঁকে' নিয়ে ভণিতা করলাম, তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কবি সুকান্তর জন্ম হয়েছিল মামারবাড়ি কালীঘাটে। আর 'সুকান্ত' নামটি দিয়েছিলেন জ্যাঠতুতো দিদি রানি। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, মনীন্দ্রলাল বসুর গল্প পড়তে ভালোবাসতেন। মনীন্দ্রলালের গল্পের নায়ক, 'সুকান্ত'-নামের একটি ছেলে। গল্পের পরিণতিতে সেকালের দুরারোগ্য যক্ষ্মা রোগে সে মারা গিয়েছিল। পড়তে পড়তে চরিত্রটিকে রানিদি এত আপন করে ফেলেছিলেন যে, পরিশেষে তার মৃত্যুটা বড্ড বুকে বেজেছিল তাঁর। মাঝে মাঝে সেটাই তাঁকে হন্ট করতো। তাই চেতনে হোক বা অবচেতনের টানে--তিনি আদরের খুড়তুতো ভাইটির নাম রাখলেন, 'সুকান্ত'। এবং আশ্চর্য সমাপতন, গল্পের পরিণতিকে সত্যি করে বাস্তবের সুকান্তও চলে গেলেন যক্ষ্মা রোগে। অকালে। এই সমাপতনটি অবশ্য রানিদিকে দেখতে হয়নি, নিজেকে দায়ী করে আত্মনির্যাতন করতে হয়নি। সুকান্তর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখনই তিনি মারা গিয়েছিলেন।
শ্যামবাজারের নিষ্ঠাবান পুরুত-ব্রাহ্মণ নিবারণ ভট্টাচার্য। অকালে প্রথমা পত্নীর মৃত্যু হল। তখন তাঁর বয়স একত্রিশ। বিয়ে করলেন এগারো বছরের সুনীতিকে। এঁদেরই দ্বিতীয় সন্তান, সুকান্ত। সাহিত্যপাঠে সুনীতির খুব ঝোঁক। ছেলে কান্নাকাটি করলে ছেলেভুলানো ছড়া কাটেন, সুর করে কাশীদাসী শোনান। আর তাতেই ছেলে একেবারে শান্ত।
নিবারণ মানুষটা বাইরে কাঠখোট্টা হলেও ভেতরে কিন্তু, বেশ রসিক। সেবার সুকান্ত ও সুকান্তর ছোট ভাইকে নিয়ে তিনি শ্যামবাজার থেকে বাসে উঠলেন। সুকান্ত বয়স তখন বছর ছয়। ভাইটির চার। কন্ডাক্টার ভাড়া চাইতে এলো। পকেট থেকে ক'টা পয়সা বার করে ছোট ছেলেটিকে দেখিয়ে নিবারণ বললেন, এর নিশ্চয় ভাড়া দিতে হবে না! কন্ডাক্টার ছোটকে জরিপ করে বলল, না, দিতে হবে না। কিন্তু, সুকান্তকে দেখিয়ে বলল, এর ভাড়া লাগবে। অমনি নিবারণ রসিকতা করে বললেন, বাসে এতো লোক, ধরেই নাও না এ তাদেরই কেউ!--বলেই নিজে একগাল হেসে ফেললেন। কিন্তু, এ-রসিকতা সুকান্তর মোটেই ভালো লাগল না, মানেও লাগল! রেগেমেগে তিনি পরের স্টপে নেমে হন হন করে হাঁটতে লাগলেন। কী হল রে, এখানে নামলি কেন!--বলতে বলতে ছোট ছেলেকে নিয়ে তাঁর পিছু পিছু নেমে নিবারণকেও ছুটতে হল। সুকান্ত তখন অনেকটা এগিয়ে গেছেন, তাঁকে ধরতে একেবারে হাঁফিয়ে গেলেন। কি রে, অমন দুম করে নেমে গেলি যে! অভিমানে-রাগে ঠোঁট ফুলিয়ে সুকান্ত বললেন, ভাই তোমার ছেলে, আর আমি বুঝি তোমার কেউ নই, না!
সুকান্তর মাসির বাড়ি বাগবাজারে। সেখানে সুকান্ত সময়-সুযোগ পেলেই চলে যান। মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে গল্পগুজব করেন। নিজের বাড়ির চেয়ে এখানে থাকতেই তাঁর বেশি ভালো লাগে। মাঝে মাঝে থেকেও যান। কিন্তু, বাড়ির ছেলে বাড়িতেই থাকবে, এর-ওর ঘরে কেন ঘুরে বেড়াবে!--এই ছিল নিবারণের মত। সুকান্তর মাসির বাড়িতে একদিন নিবারণ গেলেন পৈতের নেমন্তন্ন করতে। সেখানে একেবারে বাপের সামনে পড়ে গেলেন সুকান্ত। মুখোমুখি। এই রে, মাসির কাছেই বাবা এক্ষুনি দু'চার কথা না শুনিয়ে দেন! মানে মানে কেটে পড়তে চাইলেন। হল না। তাঁকে ডাকলেন নিবারণ। 'শুনুন সুকান্তবাবু!' সুকান্তকে থামতে হল। নিবারণ হাতজোড় করলেন, 'অমুকদিন দয়া করে বাড়িতে আসবেন, ওইদিন আমার মেজো ছেলের উপনয়ন!' মাসি তো জামাইবাবুর কাণ্ড দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন। শালী কিনা! কিন্তু, ভেতরের ইঙ্গিতটা বুঝে ভীষণ লজ্জা পেলেন সুকান্ত। আসলে, ইতোমধ্যে ক'দিন তিনি বাড়ি যাননি এবং পৈতেটা যে তাঁরই!
মায়ের মুখে পয়ার-ত্রিপদী আর বাবার মুখে শুদ্ধ সংস্কৃত শ্লোকের পাঠ শুনতে শুনতে সুকান্তর কবিমন আর ছন্দের কান ছোটবেলাতেই তৈরি হয়ে গেল। পাঁচ-ছ বছর বয়সেই মুখে মুখে ছড়া কাটতে শুরু করলেন। সবাই তাতে বেশ মজা পেতে লাগলেন, আর ডাকতে লাগলেন 'কবি' বলে। পড়াশোনা, লেখা আর বাল্যজীবন যেন এক ছন্দে ছুটতে লাগল তখন। ছন্দ কাটল বারো বছর বয়সে। মা মারা গেলেন ক্যান্সারে। মধুপুরে। হাওয়া বদল করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে। সুকান্ত তখন কলকাতায়, জেঠিমার কাছে। মায়ের মৃত্যু চোখে দেখলেন না বটে, কিন্তু, সব যে শূন্য হয়ে গেল! সংসারটাও ছন্নছাড়া হয়ে গেল। সবাই সেই বিচ্ছিন্নতা মেনে নিল, সুকান্ত পারলেন না। সেই শুরু হল তাঁর ছন্নছাড়া জীবন। শোক ভুলতে বাবা সারাদিনটাকে কাজে কাজে ব্যস্ত করে তুললেন। বাড়িতে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি মাতৃহারা ছেলেপুলেগুলোকে ঠিকমতো দেখভাল করে সংসারটাকে ধরে রাখবেন। চাকরবাকরেরা সংখ্যায় বাড়ল, কিন্তু, যত্ন বাড়ল না। চলল রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা, অনাহার-অর্ধাহারের দিন। রাজনীতি ও কাব্যচর্চার দিন। যৌবনেই রোগ এসে ধরলো, ক্ষয় রোগ। এ-বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করার স্বপ্ন দেখা কবি, স্বপ্ন বয়ে অকালে চলে গেলেন। রেখে গেলেন 'ছাড়পত্র', 'ঘুম নেই', 'পূর্বাভাষ'-এর মতো স্বপ্নমালা।
জন্ম ও মৃত্যুর মাসটিকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকান্তর অদ্ভুত উল্টোমিল লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু শ্রাবণে, আর এ-মাসেই জন্ম সুকান্তর। বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মমাস, অথচ এটাই সুকান্তর মৃত্যুমাস! আজ, সুকান্তর মৃত্যু দিন।