পায়ে পায়ে সমুদ্র: পর্ব - ১

হিমেল হাওয়ার সুবাস জানান দেয় শীত আগত। ভোরের কুয়াশায় মন উড়ু উড়ু। মনে হয় ক্ষণিকের এই অতিথিকে আগলে রাখি হাতের মুঠোয় । ইচ্ছে হয় শীতের ঝটিকা সফরকে প্রতিদিনের যাপনে রাঙিয়ে তুলি। বিশের বিষে ক্লান্ত শরীর-মন খানিকের জন্যে ছুটি পেতে চায়। ঠিক সেই সময় দেবদূতের মতো বার্তা এসে পৌঁছয়। দুয়ার টপকে বেরিয়ে পড়ার হাতছানি। মন হামিং বার্ডের মতো নাচতে থাকে।

Chandipur-1

ডিসেম্বরের শেষে ঠিক হয় ওড়িশার উপকূলে যাওয়া হবে। আসলে সমুদ্রের বুকে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাব নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্য। ট্রেক শব্দটি আমার কাছে নতুন নয়। এর আগেও ট্রেক করেছি। তবে সেটা ছিল পাহাড়ের বুকে দুঃসাহসিক দাপাদাপি। চোখে চোখ রেখে ভালবাসার নিবেদন। আর এবার পাহাড়ের বদলে সমুদ্র। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে একটু আলাদা।

কোস্টাল ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা ঝুলিতে একদম ছিল না। সমুদ্রের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা এর আগে করা হয় নি। সাগরের সঙ্গে আলাপ থাকলেও বন্ধুতা ছিল না। আসলে করার ইচ্ছেও সেভাবে হয় নি। বিষের দহন জ্বালা থেকে রেহাই পেতে তাই বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস বেরিয়ে পড়েছিলাম তাই তো নতুন করে খুঁজে পেলাম।

Chandipur-2

নির্ধারিত দিনে রুকস্যাক কাঁধে চাপিয়ে পৌঁছে গেলাম হাওড়ার বড় ঘড়ির সামনে। মোট দশজন সফর সঙ্গী। একে একে সবাই হাজির। ১:২৫ মিনিটে বালাসোর এক্সপ্রেস। ট্রেন নির্ধারিত সময়েই স্টেশন ছাড়লো। প্রথম গন্তব্য বালাসোর। পৌনে পাঁচটার মধ্যে বালাসোর স্টেশন ছুঁলো আমাদের ট্রেন। সেখান থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে আমরা চললাম চাঁদিপুরের উদ্দেশ্য।

চাঁদিপুরে আগে থেকে হোটেল বুক করা ছিল। ছ'টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাওয়ার কথা। তবে রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ায় আমাদের হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা বেজে যায়। বীচের খুব কাছেই ছিল 'চাঁদিপুর হোটেল'। বেশ ছিমছাম। হোটেলের রুমে ঢুকে সবাই ফ্রেশ হয়ে লক্ষ্মণদার হোটেলে রাতে ডিনারের জন্য রওনা দেওয়া হয়। লক্ষ্মণদা বাঙালি। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ওড়িশার চাঁদিপুরে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনে মিলে হোটেলের ব্যবসা চালাচ্ছেন। রান্নাও যথেষ্ট ভালো। ডিনার শেষে রুমে ফিরে আসা হল।

Chandipur-3

পরেরদিন চাঁদিপুর থেকে শুরু হবে আমাদের সফর। খাবার-দাবারের সঙ্গে ট্রেকিং এর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করা চললো। পরেরদিন সকালে যাত্রা শুরু। আমরা মোটামুটি সবাই জানি চাঁদিপুর আইটিআরের জন্য প্রসিদ্ধ। ওড়িশার উপকূলে চাঁদিপুরের এই জায়গায় রয়েছে ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট রেঞ্জ। ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থার (ডিআরডিও) তৈরি মাঝারি ও ছোট মাপের ক্ষেপণাস্ত্র এখানেই পরীক্ষার জন্য প্রয়োগ করা হয়। তাই এখানকার সমুদ্র উপকূলবর্তী জলে তেল দেখা যায়।

পরেরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়লাম। একটি জেলে গ্রাম আর মাছের আড়তের ভিতর দিয়ে যাব বুড়িবালাম নদীর তীরে। বুড়িবালাম নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছনোর পর শুরু হবে আমাদের কোস্টাল ট্রেকিং। বুড়িবালাম নদীর কাছে যাব, শোনার পর থেকেই ভীষণভাবে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম।

Chandipur-4

আজ থেকে একশো বছর আগে বালাসোরের উপকূলে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্যার্থে সুদূর জার্মানি থেকে অস্ত্র আসার কথা ছিল। বাঘা যতীন ও তাঁর সঙ্গী বিপ্লবীরা নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুদিন আগে থেকে উপকূলবর্তী জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। বিপ্লবীদের সন্ধানে ওই এলাকা তন্ন তন্ন করে চিরুনী তল্লাশি চালাচ্ছিল ব্রিটিশ পুলিশ। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর শেষ পর্যন্ত সম্মুখ সমরের সিদ্ধান্ত নেন বাঘাযতীন। ৮ সেপ্টেম্বর বুড়িবালামের নদীতীরে উপস্থিত হন। একটি ডোবার মধ্যে সবাই লুকিয়ে থাকেন।

আমরা মাছের আড়তের ভিতর দিয়ে হেঁটে হাজির হলাম বুড়িবালাম নদীর তীর। নদীর তীরে সারি সারি ট্রলার, লঞ্চ দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে জীবন যুদ্ধে নামার আগাম প্রস্তুতি চলছে। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই নদীর কূলেই বিপ্লবী বাঘা যতীন তাঁর সঙ্গী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষ চন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত মাউজার পিস্তল হাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

Chandipur-5

উল্টোদিকে ছিলেন চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভিসহ অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ ও সামরিক বাহিনী। অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত অসীম সাহসের সঙ্গে পাঁচজন দেশমাতার সন্তান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছিলেন বিপ্লবী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। আহত বাঘাযতীনকে বালাসোরের সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই পরদিন তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে রক্ত বমি হচ্ছিল তাঁর। তাই দেখে তিনি হেসে বলেছিলেন "এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।"

নদীর তীর থেকে কিছুটা দূরে লঞ্চ বাঁধা ছিল‌। আমরা জলের মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে লঞ্চে উঠি। যাত্রী বোঝাই হলে লঞ্চ ছেড়ে দেয়। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা ওপাড়ে পৌঁছে যাই। এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের হাঁটা। প্রথমে একটি গ্রাম পেরিয়ে উঠতে হবে সমুদ্রের বুকে। সমুদ্রের বুক চিরে এগিয়ে যেতে হবে। ডানদিকে সাগর আর বামদিকে ঝাউবন। গন্তব্যস্থল কসাফল। (চলবে)

 

ছবি উৎস মুখার্জি

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...