ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টার যদি দেবানন্দ হন, তাহলে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার কে? ভাবুন, একটু ভাবুন। পারলেন না তো? সিকে নাইডু।
কিন্তু কেন? ১৯২৬ সালের একটা তিনদিনের ম্যাচের কথা। ভারত প্রথম সরকারি টেস্ট খেলেছে ১৯৩২ সালে, মানে তখনও ৬ বছর দেরি আছে। স্বাধীনতা পেতে জোর কদমে লড়ছে ভারত। নেতৃত্বে মহাত্মা গান্ধী। এমন এক সময়ে ভারতে এমসিজি'র দল এল কয়েকটা ম্যাচ খেলতে। নামেই এমসিজি, আসলে তা পূর্ণশক্তির ইংল্যান্ড দল।
হিন্দুদের সঙ্গে বোম্বের জিমখানা মাঠে ম্যাচের আয়োজন হয়। প্রথম দিনের শেষে এমসিজি করল ৩৬৭। জবাবে হিন্দুদের স্কোর নড়বড়ে ১৬/১। দ্বিতীয় দিনের খানিকক্ষণের মধ্যেই আরও দুটো উইকেট পড়ে যাওয়ার পর লম্বা লম্বা পা ফেলে হিন্দুদের ব্যাটিঙের হাল ধরলেন কর্নেল সিকে নাইডু। তৃতীয় বলটাই ‘ফুল স্যুইং অফ দ্য উইলো’। বল চলে গেল টেন্টের ছাদে। দর্শকদের অনেকেই কর্নেলকে চেনেন, তাঁরা জানতেন এ তো ট্রেলার। পিকচার অভি বহুত বাকি হ্যায়।
তার পরের ঘটনা বারবার চোখ কচলে দেখার মত। চার চারটে টেস্ট বোলারের মধ্যে কেউই সেদিন রেহাই পান নি সিকের হাত থেকে। লাঞ্চে সিকে ৫৩। দাবানলের মতো বোম্বের অফিস, কোর্ট, কলেজ - সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল কর্নেল মার রাহা হ্যায় আওয়াজ। কাজকর্ম শিকেয় তুলে হেঁটে, বাস বা লোকাল ট্রেনে করে মাঠ তো বটেই, আশেপাশের সমস্ত বাড়ি এবং অফিসের ছাদ এবং গাছের ডাল ভরিয়ে ফেলল বোম্বের মানুষ। ইংল্যান্ডের এক রিপোর্টারের ভাষায় তখন যেদিকেই তাকানো হোক না কেন শুধু ক্ষুদে ক্ষুদে মাথা দেখা যাচ্ছে।
লাঞ্চের পর নাইডু যেখানে ছেড়েছিলেন ঠিক সেখান থেকেই ব্যাটিং শুরু করলেন। শেষে দুই ঘণ্টার কিছু কম সময়ে যখন ১৫৩ রানের একটা অভাবনীয় ইনিংস খেলে উনি ফিরলেন তখন ভারতীয়দের আত্মসম্মানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মোট এগারোটা ছয় উনি মেরেছিলেন সেদিন। তার মধ্যে প্রথমটা ছাড়াও আরও দুটো গিয়ে পড়েছিল টেন্টের ছাদের উপর।
এরপর বিদেশে গিয়েও সাহেবদের ঠেঙিয়ে এসেছিলেন তিনি। তাঁর একটা হুক শট মাঠ আর তার পাশে উরস্টাশায়ার কাউন্টির নদী পেরিয়ে গিয়ে ওপাশে পড়েছিল। ওনার এরকমই কিছু শটের গল্প এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে পুরনো জমানার ক্রিকেট প্রেমিদের মধ্যে।
ভারত যখন টেস্ট খেলা শুরু করে তখন কর্নেলের বয়স ৩৭, এই বয়েসে সাধারণত ক্রিকেটাররা রিটায়ার করে কমেন্ট্রি, কোচিং ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেন। সুতরাং ওনার টেস্ট রেকর্ড যে আহামরি হবে না সেটা স্বাভাবিক। যারা ওনার সঙ্গে বা বিপক্ষে খেলেছেন বা ওনার পিক ফর্মে মাঠে বসে খেলা দেখেছেন তাদের মধ্যে সবাই মোটামুটি একই কথা বলেছেন যে কর্নেল সি কে নাইডু অনবদ্য।
নেভিল কার্ডাস তো নাইডুকে কোন এক সাংবাদিক ‘ভারতীয় ব্র্যাডম্যান’ বলায় বিরক্ত হয়ে যা লিখেছিলেন তার সারমর্ম এই – “নাইডুর ব্যাটিং কাব্যময় - শিল্প এবং সুষমায় ভরা, কখনই তা ব্র্যাডম্যানের মত মেকানিক্যাল নয়। ওনার কাছে টেকনিক মাথা নিচু করে দাসত্ব করে, প্রভুত্ব নয়। ক্রিকেটের মহান অনিশ্চয়তাকে নাইডুর ব্যাটিং কখনই বিপদে ফেলে দেয় না।“
লিয়ারি কন্সট্যানটাইন আর কর্নেল এক দলের হয়ে খেলছেন, বিপক্ষ দলে বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছেন মহম্মদ নিসার – সেই সময়ের বিশ্বের দ্রুততম বোলারদের অন্যতম। লিয়ারিকে অনেকে বিশ্বের প্রথম টি ২০ ক্রিকেটারের শিরোপা দিয়ে থাকেন। হামেশাই এক ঘণ্টার কম সময়ে সেঞ্চুরি করতেন এই ভদ্রলোক আর সেই সঙ্গে ছিল বিধ্বংসী ফাস্ট বোলিং।
আর উইকেটের কাছে বা দূরে দুটোতেই উনি বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফিল্ডারদের মধ্যে অন্যতম। লিয়ারি নিসারের সম্মুখীন। ওপর প্রান্তের উইকেট পড়ে যাওয়ায় এবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন কর্নেল। কর্নেলকে লিয়ারি তেমন চিনতেন না, গম্ভীর মুখে এসে ওনার পিঠে হাত দিয়ে তিনি ওনাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে নিসারকে ডরাবার কোন কারণ নেই কারণ ওকে উনিই ফেস করবেন, কর্নেল যেন শুধু সোজা ব্যাটে খেলে নিজের উইকেট সামলে রাখে। বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নাড়লেন কর্নেল।
কিছুক্ষণ সবকিছু লিয়ারির প্ল্যানমতো চললেও শেষে দেখা গেল নিসারের একটা নতুন ওভারের সামনে ব্যাট নিয়ে দাঁড়াতে হোল কর্নেলকে। নন স্ট্রাইকারের এন্ডে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে লিয়ারি দাঁড়িয়ে। সি কে নাইডু যে কি জিনিস ওই এক ওভারেই বুঝে গেলেন লিয়ারি কন্সট্যানটাইন। নিসারের বাম্পারের জবাবে ওনার সপাটে মারা হুক শটগুলো আর লেন্থ বলে মারা দৃষ্টিনন্দন ড্রাইভগুলো দেখে ওভারের শেষে ইয়া বড় হাসি হেসে এসে জড়িয়ে ধরলেন তিনি কর্নেলকে। ‘বেশ ঠকিয়েছ আমাকে, অ্যাঁ? তুমিও তো দেখছি চ্যাম্পিয়ন। ইউ আর দ্য বেস্ট, ম্যান!’ এই ম্যাচের সময় নাইডুর বয়স ৪৫। ৬২ বছর বয়সেও উঁচুমানের বোলিং ঠেঙানোর কৃতিত্ব আছে একাধিকবার।
কর্নেল সি কে নাইডু শুধু অসাধারণ ব্যাটসম্যানই ছিলেন না, তাঁর মিডিয়ম পেস বোলিংও যথেষ্ট কার্যকর ছিল। সেই সঙ্গে উনি ছিলেন উঁচুমানের নির্ভরযোগ্য ফিল্ডার। একবার লর্ডসে সেই এমসিজির বিরুদ্ধে একটা শক্তি আর সৌন্দর্যে ভরপুর সেঞ্চুরি, ৩৯/৪ এনালিসিসের বোলিং আর একাধিক অসাধারন ক্যাচ নিয়ে ফিরে আসার পর বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন ওনাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আর কী কী পারেন আপনি? উইকেট কিপিং?’
ওনার সঙ্গে ফ্র্যাঙ্ক উলির তুলনা করেন বডিলাইন খ্যাত ডগলাস জারডিন, আরও এক বোদ্ধা সোয়ানটনের মনে পড়ে গেছিল রঞ্জিকে। আধুনিক প্রজন্ম হয়ত জানেন না – উলি বা রঞ্জিকে শিল্পময় ব্যাটিঙের বেঞ্চমার্ক হিসেবে ধরা হত। মহারাষ্ট্রের নাগপুরে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত এই ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ সময়কালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অন্ধ্রপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দলে তিনি মূলতঃ ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন তিনি।
দীর্ঘদেহী ও ছন্দময় ভঙ্গিমার অধিকারী ছিলেন নায়ডু। তার নিকটতম দলীয় সঙ্গী সৈয়দ মুসতাক আলী তাকে মজা করে ‘মাঠের বাঘ' বলে ডাকতেন। ১৯৬৩-৬৪ মরসুমে দাতব্য খেলায় সর্বশেষ খেলেন সিকে। মহারাষ্ট্রের গভর্নর একাদশের সদস্যরূপে মহারাষ্ট্র মূখ্যমন্ত্রী একাদশের বিপক্ষে খেলেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে ৬৮ বছর বয়সেও আবার খেলার জগতে ফিরে এসেছিলেন।
মে মাসে এমসিসি’র বিপক্ষে তৃতীয় ও খেলার শেষদিনে আবহাওয়ার কারণে ড্রয়ের দিকে গড়ায়। তা সত্ত্বেও, নায়ডু তাঁর অপূর্ব ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর সংগৃহীত অপরাজিত ১১৮ রানের ইনিংসটি দলের মোট সংগ্রহের অর্ধেকেরও বেশি ছিল।রামচন্দ্র গুহ এ প্রসঙ্গে বলেন যে, এ সফরে এটিই তাঁর সেরা ইনিংস ছিল। একটি ছক্কা ‘ক্রিকেট স্বর্গ’ অতিক্রম করে বাইরে চলে যায়। ১৯৪১ সালে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে কোনও ব্র্যান্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন ভারত সরকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ প্রদান করে নাইডুকে।