বাংলার চুনী

ফুটবল, ক্রিকেট ,হকি যেটাই তিনি খেলেছেন তাতে জান লড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি চুনী গোস্বামী। বাংলা খেলা জগতের আসল অলরাউন্ডার।

১৯৩৮, ১৫ জানুয়ারী জন্মেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্কিল ফুল খেলোয়াড় সুবিমল গোস্বামী, ওরফ চুনী গোস্বামী। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্মেও আজীবন খেলছেন মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হয়েই। কলকাতা লীগে মোহনবাগানের হয়ে করেছেন ১৪৫ গোল, ভারতের হয়ে ৫০ ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করে ৩০ গোলের মালিক তিনি।এছাড়া এশিয়ান গেমস ১৯৬২ এর সোনা জয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।

চুনী গোস্বামী একবার কলকাতা ডার্বিতে মারাত্মক চোট পান,পা দিয়ে অঝোরে রক্ত পড়ছিল,মোহনবাগান তখন হারছে ১-০ গোলে,দ্বিতীয়ার্ধে তাকে তুলে ফেলার উপক্রম করাতে তিনি রীতিমত ঝগড়া করে খেলেছিলেন এবং একমাত্র গোল করে দলকে হারার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন,পরে চোটের কারণে তিনি ৪-৫ টি ম্যাচ আর খেলতে পারেননি এবং চোটটা তাকে বহুদিন ভোগায়।

 

ChuniGoswami1

 

সাংবাদিকরা যখন জিগ্যেস করেন ওঁকে যে কেন তিনি নিজের কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়ে খেলেছিলেন? ওনার উত্তর ছিল-যে জার্সিটা গায়ে দেই,তার হার কখনও মেনে নিতে পারিনি এবং পারবও না,সেখানে এটা ডার্বি, এই ম্যাচে চোট আঘাত তো দূরের কথা, জীবন-মৃত্যুও গুরুত্বহীন। বুঝলেন কেন লেখা হয়েছে জান লড়িয়ে খেলতেন চুনী।

১৯৬২ সালে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সোনা জিতল ভারতীয় দল। ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে পরাস্ত করল। অধিনায়ক চুনী গোস্বামী। সারা দেশে বাঙালি ফুটবলারের নামে জয়জয়কার। বলের ওপর অসাধারণ দখল তাঁর। সঙ্গে মাঠের পরিস্থিতি বোঝার আশ্চর্য ক্ষমতা। ১৯৬৪-তে এশিয়ান কাপ এবং মারডেকা টুর্নামেন্টে ভারতীয় টিম রৌপ্যপদক অর্জন করে তাঁর নেতৃত্বে। কিশোরগঞ্জে বালক মাত্র ৯ বছর বয়সে মোহনবাগানের জুনিয়র টিমে খেলা খেলা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে যোগ দেন সিনিয়র টিমে। ১৫ বছর খেলেছেন মোহনবাগানের হয়ে। ৬ বার ডুরান্ড কাপ এবং ১০ বার কলকাতা লিগ বিজয়ী দলে ছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ অবধি মোহনবাগানে পালন করেন অধিনায়কের দায়িত্ব। তাঁর কৌশলী নেতৃত্বে পরপর ৩ বার ডুরান্ড কাপ জিতে নেয় মোহনবাগান।

 

ChuniGoswami2

চুনী গোস্বামীকে বলা হত ‘ড্রিবলিংয়ের রাজা’চিনের অলিম্পিক টিমের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক খেলায় পা রাখেন। ৫০টি ম্যাচ খেলেন জাতীয় দলের হয়ে। অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, এশিয়া কাপ, মারডেকা কাপে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। ভারতীয় ফুটবল টিমের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ছিলেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফুটবল থেকে অবসর নেন, যখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে। ক্রিকেট খেলায় মনোনিবেশ করেন। অবশ্য ফুটবলের আগে তিনি স্কুল জীবনে ক্রিকেট খেলেছেন বাংলার হয়ে।

সব মিলিয়ে ৪৬টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছিলেন চুনী গোস্বামী। বাংলা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর অধিনায়কত্বে বাংলা রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে উঠে হেরে যায় মুম্বাইয়ের কাছে। জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য তাঁর নাম বিবেচিত হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে পারেননি তিনি। তবে ১৯৬৬ সালে বিশ্বসেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে খেলা ক্রিকেটারদের নিয়ে যৌথ একাদশে স্থান পেয়েছেন। চুনী ছিলেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। ডানহাতে মিডিয়াম পেস বল করতেন। বুঝলেন কেন অলরাউন্ডার চুনী

 

ChuniGoswami3

 

‘অলরাউন্ডার’ চুনী গোস্বামী হকি খেলাতেও ছিলেন দক্ষ। সাউথ ক্লাবে নিয়মিত টেনিস খেলতেন। বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সারা জীবনে। এশিয়ার সেরা স্ট্রাইকারের পুরস্কার, অর্জুন পুরস্কার, পদ্মশ্রী সম্মান, মোহনবাগান রত্ন লাভ করেন। ২০০৫ সালে কলকাতার শেরিফ নির্বাচিত হন। ‘প্রথম প্রেম’ নামের এক বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন।

১৯৬২ সালের জাকার্তা এশিয়াডের সোনাজয়ী এই ভারতীয় অধিনায়ক সরকারী এবং বেসরকারী মিলে মোট ৪৮ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অন্ততঃ ১৩ টি গোল করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট, ফুটবল এবং টেনিসের দলে থাকা এই কিংবদন্তী ১৯৬২ সাল থেকে প্রায় দেড় দশক বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলেন।

তিনি দুবার রঞ্জি ফাইনাল খেলেছিলেন, যার মধ্যে একবার অধিনায়ক হিসেবে। সমগ্র ভূ-ভারতে তিনিই একমাত্র ক্রীড়াবিদ, যিনি সন্তোষ ট্রফি এবং রঞ্জি ট্রফি- এই দুটি টুর্নামেন্টেই রাজ্যদলের অধিনায়ক ছিলেনফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ও ক্রিকেটে রানার্স হন। তাঁর সেরা বোলিং ৪৭ রানে ৫ উইকেট। লয়েড সমৃদ্ধ বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের যৌথ দলের কাছে হারতে বাধ্য করেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১টি শতরান সহ ১৫৯২ রান এবং ৪৭ টি উইকেট পেয়েছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...