অনিন্দ্যসুন্দর চোপতা

সারা বছরের একঘেয়েমি, ক্লান্তিকর, বঞ্চনা অবসাদ ঘিরে থাকা জীবনে একটুখানি দখিনা বাতাসের স্পর্শ লাগে যখন তল্পিতল্পা নিয়ে অচিন দেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। পুজোর সময়ই আমাদের একটু ফুসরত মেলে কাছে দূরে, নীল নির্জনে হারিয়ে যেতে।

 

সে বছরও আমরা বেরিয়ে পড়লাম গারোয়ালের দিকে। গন্তব্য বদ্রীনারায়ণ। হরিদ্বার থেকে গাড়ি নিয়ে জোশীমঠ হয়ে বদ্রী। ফেরার পথে কিন্তু একটু ঘুরপথ ধরলাম। বদ্রী নারায়ণ থেকে গোবিন্দঘাট হয়ে পাণ্ডুকেশ্বর, তারপর সেখান থেকে চামোলি হয়ে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চোপতারই ঘন জঙ্গল পেরিয়ে চোপতা বুগিয়াল

 

Chopta1

 

চোপতা কেদারনাথ রুট দিয়ে গেলে অনেক কাছে কিন্তু বদ্রীনারায়ণের পথ দিয়ে এলে অনেকটা পথ। গন্তব্য আমাদের উখিমঠ। দীর্ঘ তুষারশুভ্র শৃঙ্গরাজি, ঘন সবুজ পর্বতমালার সারি, ঘন জঙ্গল, নাম না জানা গাছ, নানা রঙে রঙিন ফুলের জলসা, রংচঙে প্রজাপতি, আর নানা রকমের অচিন পাখির কলতানকে সঙ্গে নিয়ে ৯৫০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ি গ্রাম চোপতায় এসে মন বেহিসেবি। একদিনের অবকাশ যাপন নাহয় হিসেবের বাইরেই হল। তুঙ্গনাথ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত চোপতা।

গাড়ি থামিয়ে পাহাড়ি পথে ক্ষনিকের বিশ্রাম আর পাহাড়ি রূপে অবগাহন করে নেওয়া। চারিদিকে সবুজ গালিচা পাতা বুগিয়াল দেখে মন হারিয়ে যায় কোন সুদূরে। দূরে বরফে ঢাকা চৌখাম্বা, গৌরিশঙ্কর, সুমেরু, ত্রিশূল, ডোম, কেদারনাথ, যোগিন, বান্দরপুঁছ, গঙ্গোত্রী শিখর বরফের মুকুট পরে দৃশ্যমান।

 

Chopta2

 

চোপতা হল তুঙ্গনাথ যাওয়ার মূল ফটক। চোপতায় এসেই তুঙ্গনাথ যেতে হয় পায়ে হেঁটে। অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্যের অধিকারী চোপতা। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা চলে গেছে, বহু নিচে বয়ে চলেছে নদী, অতলস্পর্শী খাড়াই খাদ যাত্রাপথের সঙ্গী সবসময়, আবার তীব্র বাঁক ও বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। কখনো পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ, কখনো মেঘে ঢাকা আকাশ চোপতার প্রকৃতিকে যেমন মোহময়ী করে তুলেছে তেমনি পাহাড়ের অতিলৌকিক, অতিপ্রাকৃত চরিত্রও আমাদেরকে ওই জগতে নিশির ডাকের মতো ডাকে।

 

ঘন জঙ্গলে ঢাকা নানা ধরনের গাছ গাছালিতে সমৃদ্ধ এই পাহাড়ি গ্রাম। রডোডেনড্রন, দেওদার, ম্যাপল, চেস্টনাট, আর ফার গাছে ছাওয়া। জঙ্গলে রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড ও ঔষধি গাছ। এই বিখ্যাত জঙ্গল কেদারনাথ স্যাংচুয়ারীর অন্তর্ভুক্ত। বন্যপ্রাণী প্রচুর পরিমানে রয়েছে। তার মধ্যে তেন্দুয়া (Leopard), কালো ভাল্লুক, বুনো শুয়োর, নানা প্রজাতির বাঁদর, হনুমান, থর (Himalayan Tahr), বার্কিং ডিয়ার, আর দুর্লভ কস্তুরী মৃগ। চোপতা ২২৫ প্রজাতির পাখির মুক্ত বিচরণভূমি। উত্তরাখণ্ডের রাজ্যের জাতীয় পাখি মোনাল (দেখতে পেখমহীন ময়ূর) এখানেই রয়েছে।

 

Chopta3

 

হিমশীতল আবহাওয়া তাই প্রচন্ড ঠান্ডা। শীতকালে বরফে আবৃত থাকে। বিদ্যুৎ সংযোগহীন পাহাড়ি অতিলৌকিক গ্রামে থাকার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ঝুলিতে পুরতে হলে আসতেই হবে চোপতায়। থাকার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি হোটেল।

তুঙ্গনাথ যাওয়ার মূল প্রবেশ পথ চোপতায়। রডোডেনড্রনের জঙ্গল দিয়ে চড়াই পথে তুঙ্গনাথ ভারতবর্ষের উচ্চতম শিবমন্দির। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চন্দ্রশীলা গিয়ে হিমালয়ের নামজাদা শৃঙ্গের উপর রবির প্রথম কিরণ দেখার সৌভাগ্যলাভ করেন পর্যটক এবং ভ্রমনার্থীরা। চোপতা থেকে এগিয়ে উখিমঠের দিকে যেতে মাঝখানে সারি গ্রাম। দেওরিয়া তাল যাওয়ার বেসক্যাম্প বলা যায়। তালের জলে চৌখাম্বায় প্রতিবিম্ব দেখতে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান দেওরিয়াতালে। তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা আর দেওরিয়া তাল ভ্রমণপিপাসুদের স্বর্গরাজ্য।

 

সকালে স্বর্ণ মুকুট পরিহিত চৌখাম্বা অন্যান্য শৃঙ্গের ঝলমলে স্বর্ণালী রূপ, বিকেলে বিষন্ন সূর্যাস্ত, পাখির কলতান, জঙ্গলের নিস্তব্ধতা আর গভীর রাতের আধিভৌতিক অপ্রাকৃতিক শব্দ, পাতায় পাতায় ফিসফাস, পাখির কলকাকলি, ক্রমাগত বয়ে যাওয়া নদীর কলোচ্ছাস অনুভবের জন্য যেতেই হয় মিনি সুইৎজারল্যান্ড চোপতায়। রং বেরঙের জঙ্গল, সবুজ পাহাড়, সবুজ গালিচা মোড়া বুগিয়াল, অতলস্পর্শী নদী,গভীর গিরিখাত, তুষারশুভ্র তাজ পরিহিত হিমালয় শৃঙ্গ সব মিলিয়ে প্রকৃতির তুলির টানে আঁকা এক অপরূপ ল্যান্ডস্কেপ "চোপতা"।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...