তখন গত শতকের তিরিশের দশক। পরের দশকের শুরুতেই জাগতিক রবির অস্তমিত হওয়ার পালা। শরীর ভাঙতে শুরু করেছে। নানান উপসর্গের ফিকিরে ডা: নীলরতন বাবুর পরামর্শে পাহাড়ে যাওয়ার কথা উঠল। কিন্তু এবারে নতুন ঠিকানা। পাহাড়ের ঢালে সাজানো বস্তি। যেন প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়েছে সেই শোভা। স্নিগ্ধ পরিবেশে মাত্র এক একর জমির উপরে তৈরি বাড়িটি আজও স্বর্গদ্বার।
কবিগুরুর হাতের কাজের ছোঁয়া আজও অনুভূত হয় সেই ঠিকানায়। তাঁর কারুকাজে কাঠের টি টেবিল, লাঠি ও আরও অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই বাড়ির আনাচে-কানাচে। পাহাড় আর নীল দিগন্ত যেখানে মিশেছে, সেখানেই জন্ম এই রবীন্দ্র স্মরণিকার। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের জমিদার রায়চৌধুরী পরিবারের শৈলাবাস ছিল পূর্বের এই ‘গৌরীপুর হাউস’। ত্রিশের দশকে বারংবার কবি পা রেখেছেন এই বাড়িতে। উদ্যেশ্য গ্রীষ্ম যাপন। এই বাড়িই তখন একলা রবির সৃজনভূমি।
কবির সঙ্গে পাহাড়ের যোগাযোগ নিবিড়। কালিম্পংয়ে গিয়েছেন চার বার। পাহাড় নিয়ে ভালোবাসা ঠাঁই পেয়েছে তাঁর অসংখ্য চিঠি, কবিতা এবং অন্য লেখায়।১৯৩৮ এর ২৫ এপ্রিল। কবি তখন আটাত্তরের প্রাজ্ঞ, বয়সে ধূসর। প্রথম পা পড়ল কালিম্পং এর কংক্রিটে। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী খবর পেলেন বিশ্বকবির আগমনের। নিজের শৈলাবাসটি ছেড়ে দিলেন কবিগুরুর বিশ্রামের জন্য। মনোরম পরিবেশ। আলোর প্রাচুর্য। বিরাট মাপের দরজা জানালা। বারান্দা থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথু লা। অন্যপাশে অবস্থান করছে সিকিম রাজ্য।
শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে ততক্ষণে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন ভানু সিংহ। মেঘ জানান দিচ্ছে সামনেই কবি পক্ষ। এই প্রথম পাহাড়ে পালিত হবে কবির জন্মদিন। জন্মদিন কবিতাটি আবৃত্তি করবেন কবি। এসেছেন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ কলকাতা শাখার অধ্যক্ষ। কবি কণ্ঠে সেদিন জন্মদিন যেন পাহাড় মুখরিত। শান্ত প্রকৃতির আর চঞ্চল মন এক হলে যে ভীষন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরপর ১৯৪০ -এর ২০ সেপ্টেম্বর। ফের কালিম্পং যাত্রা। এবারে ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করেই। কথা ছিল মংপুতে নিজ আবাসে যাওয়ার। কিন্তু বদলে যায় ঠিকানা। পুত্রবধূ প্রতীমা দেবীর নান্দনিক ছোঁয়ায় সেজে উঠল গৌরীপুর ভবন।
জীর্ণ কবি মন পাহাড়ের ভরা শরতে মেলে ধরল নিজেকে। লেখা বেরোলো কলম থেকে। পঁচিশে সেপ্টেম্বর অসুস্থ হন কবি। বুঝেছেন চলে যেতে হবে সুন্দর ভুবনের মায়া ছেড়ে। ওই সময় ‘জন্মদিনে’ ১৪ সংখ্যক কবিতাটি শেষ রচনা করলেন। কবি মৃত্যুর পরে ‘চিত্রভানু’র দেওয়ালে মার্বেল পাথরে ওই কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাই করা হয়। নীচে অবনীন্দ্রনাথ কৃত তাঁর ছবি।
কবির পরম সাধ থাকলেও মেটেনি আশ। এই বাড়ি আসলে কবির নয়। তাঁর মৃত্যু পর তৈরি হয় ওই বাড়ি। শেষ বয়সে কবিগুরুর পুত্রবধূ প্রতীমা দেবীর আবাস ছিল। বাড়ির জমি লিজে নেওয়া হয়েছিল। লিজ গ্রাহক ছিলেন প্রতিমা দেবী স্বয়ং। স্বর্গত কবির স্মরণেই বোধ হয় সেই পরমা উদ্যোগ। ১৯৪১ সালে কবিগুরু প্রয়াত হন। বাড়িটি প্রতিমা দেবীর একান্ত চেষ্টায় সম্পূর্ণ হয় ১৯৪৩ সালে। সেজে ওঠে রঙ বেরঙের ফুলে। শান্তিনিকেতনে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের স্টুডিও-র নামে বাড়ির নামকরণ হয় চিত্রভানু।
স্বাধীনতার পর ১৯৬৪ সালে রাজ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তত্ত্বাবধানে এই বাড়ি এখন নারী শিক্ষা নিকেতন। পাহাড় ও সমতলের মহিলাদের হাতের কাজ শেখানো হয়। উলের জিনিস বানানো, টেলারিং, কাটিং শোখানোর ব্যবস্থা আছে। ব্যবস্থা আছে প্রদর্শনী ও বিক্রিরও। এখন চার পাশে আগাছা জন্মেছে। ২০১১ সালের ভূমিকম্পের পরে দেওয়ালে বড়ো বড়ো ফাটল। আদর মাখেনি বহুদিন সেই স্মৃতিমেদুর চিত্রভানু। প্রাকৃতিক বিপর্যয় কবি অনুরাগের প্রধান অন্তরায় এখন। ফিকে হয়েছে পুরোনো শোভা। কালিম্পংয়ে পাইনভিউ নার্সারির ঠিক উল্টোদিকে একটু উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে কবির শেষ শান্তিনিকেতন। আদরের চিত্রভানু।