জাত অভিনেতা চিন্ময়রায়

‘‘চিন্ময়ের সম্পর্কে প্রথমেই যে কথাটা বলব, ডিসিপ্লিন। খুব ডিসিপ্লিনড অভিনেতা। আসলে মঞ্চ থেকে শুরু করেছিল তো। তাই তৈরি ছিল সে সবে। আবার যখন যেমন প্রয়োজন তেমন ভাবে সিনেমায় অভিনয়ের ধারা বদলে নিয়েছিল। ও যেখানেই থাকত খুশি রাখত সকলকে। চারপাশটা আলো করে রাখত।’’--তরুণ মজুমদার।।

অভিনয় ছিল তাঁর সব কিছু। তাঁর আত্মজীবনীর শেষ লাইনটাও ছিল, ‘নাকের কাছে স্পিরিট গামের প্রিয় গন্ধটা নিয়ে আমি মরতে চাই।’ খুব সাদামাটা চেহারা নিয়েও যে অভিনেতা হওয়া যায়, এই কথাটা প্রমাণ করে গেছেন বিখ্যাত কিছু অভিনেতা। সেই উজ্জ্বল নামগুলোর মধ্যে একটি হল চিন্ময় রায়। তিনি বারবার দর্শকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে রূপ নয়, মানুষের গুণেই তাঁর পরিচয়, খ্যাতি।

অভিনয়ই কেরিয়ার হয়ে উঠবে, এ কখনও ভাবেননি চিন্ময় রায়। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন ছেলেবেলা থেকেই... ঠাকুরমার সঙ্গে যাত্রা দেখতে গিয়ে তাঁর মনে হত এমন যদি করা যেত!

ছোটবেলায় বরানগরে থাকতেন তাঁরা আর সেই সময়ের বিখ্যাত নাট্য অভিনেতা ঠাকুরদাস মিত্র -যাঁর ‘শাজাহান’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় প্রায় কিংবদন্তী- তখন সেখানেই থাকতেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিশোর চিণ্ময়ের আইডল। এইভাবেই নাটক আর অভিনয়ের ‘ভূত’ মাথায় নিয়েই মণীন্দ্র নন্দী কলেজে পড়তে এলেন তিনি।

সেখানে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব তুখোড় অভিনেতা, চটপটে, সুদর্শন অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এসেই চিন্ময়ের সঙ্গে জুটে গেলেন আর ক্লাসের সহপাঠী–পাঠিনীদের নিয়েই দুই বন্ধু মিলে তৈরি করে ফেললেন নাটকের দল।
নাটক নামল রবি ঠাকুরের ‘মালঞ্চ’। এক বিহারি চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করলেন চিন্ময় রায়।

ভাগ্যের চাকা ঘুরলও সেই নাটক থেকেই। স্বয়ং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নাটকে চিন্ময়রায়ের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে প্রস্তাব দেন অজিতেশের নান্দীকার নাট্যদলে অভিনয় করার। শুরু হল জীবনের নতুন অধ্যায়।

জন্ম হল অভিনেতা চিন্ময় রায়ের। আর এই নান্দীকারের "মঞ্জরী আমের মঞ্জরী" নাটকে চিণ্ময়ের অভিনয় দেখে তাঁকে নিজের ছবি "গল্প হলেও সত্যি" ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তপন সিংহ। আজও অদ্বিতীয় হয়ে আছে যে ছবি।

তারপর শুধুই এগিয়ে চলা। তপন সিংহ, সত্যজিৎ রায়, দীনেন গুপ্ত, তরুণ মজুমদার... বিখ্যাত পরিচালকদের একাধিক ছবিতে অভিনয়। পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় এবং নিয়মিত নাটক দেখা। নান্দীকার ছেড়ে তৈরি করেছিলেন নতুন গ্ৰুপ থিয়েটার দল "থিয়েটার ওয়ার্কশপ"...উপহার দিয়েছেন একাধিক হিট নাটক। আর সিনেমা!
চারমূর্তি ছবির টেনিদাকে কি কখনও ভুলতে পারে বাঙালি?
হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেই অবিস্মরণীয় গান "ভারত আমার ভারতবর্ষ"!!

সত্যজিৎ রায়ের একাধিক ছবিতে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। তবুও তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পান নি বলেই মনে করতেন তাঁর প্রাণের বন্ধু আরেক দিকপাল অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ কয়েকবার বলেছেন "বাংলা ছবিতে ওর যা পাওনা ছিল তা পায় নি। ওর মতো চরিত্রাভিনেতা খুবই দুর্লভ। মামুলি কমেডিয়ান হয়েই কাটিয়ে দিতে হল ওকে। অথচ কমেডিয়ান হতে গেলে যে তুখোড় অভিনেতা হতে হয় সেটা কেউ মাথায় রাখেন না"...

বাস্তব জীবনেও তিনি খুব মজার মানুষ ছিলেন। "ননীগোপালের বিয়ে" ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে অভিনেত্রী জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে। তার আগে বালিকা বধূ ছবির শুটিংয়ের সময় প্রথম দেখেছিলেন জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দু দিনের মধ্যে প্রোপোজ। বন্ধুদের বলেছিলেন "ভালো জিনিস কখনো ফেলে রাখতে নেই".. এতটাই হাসিখুশি স্বভাবের ছিলেন তিনি।

"বসন্তবিলাপ" ছবিতে চিণ্ময়ের একটি আইকনিক ডায়ালগ ছিল। প্রেমিকার উদ্দেশ্যে বলছেন.."আমাকে একবার উত্তমকুমার বলো"। না, তাঁর উত্তমকুমার হওয়ার প্রয়োজন হয় নি। বাঙালি দর্শকের মনে তিনি চিন্ময় রায় হয়েই চিরদিন থেকে যাবেন।

 

তথ্য ঋণ: বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার এবং চিন্ময়রায়ের আত্মজীবনী "যে জীবন ফড়িঙের"..

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...