বড়ই বিচিত্র শহর কলকাতা। একটি কিংবদন্তি বলে, কালী থেকেই কলকাতা নামের জন্ম। কলকাতা বহুকাল থেকেই শক্তি তথা কালীর আরাধনা করে চলেছে, এখানে যেমন শক্তিপীঠ রয়েছে, তেমনই সতীপীঠ রয়েছে। বহু পুরনো এবং জাগ্রত মন্দির ছাড়াও কলকাতায় ছড়িয়ে রয়েছে জানা-অজানা অসংখ্য মন্দির। কলকাতার চিনা বাসিন্দারাও কালীভক্ত হয়ে উঠেছেন। কলকাতার চায়না টাউনেই তৈরি হয়েছে চিনা কালীমন্দির। সেই মন্দিরের কথা জানতে ক্লিক করুন ছবিতে 👇
বড়ই বিচিত্র শহর কলকাতা। একটি কিংবদন্তি বলে, কালী থেকেই কলকাতা নামের জন্ম। কলকাতা বহুকাল থেকেই শক্তি তথা কালীর আরাধনা করে চলেছে, এখানে যেমন শক্তিপীঠ রয়েছে, তেমনই সতীপীঠ রয়েছে। বহু পুরনো এবং জাগ্রত মন্দির ছাড়াও কলকাতায় ছড়িয়ে রয়েছে জানা-অজানা অসংখ্য মন্দির। কলকাতা যেমন বহুধর্মের মিলনক্ষেত্র, এই মন্দিরগুলিই সেই বহু ধর্মের সহাবস্থানের ফসল। ভিনদেশিদের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। তারাও এই শহরের কালী আরাধনার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
ইংরেজরা কালীঘাটের কালীমন্দির যেত। হ্যান্সম্যান অ্যান্টনির ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কথা তো সর্বজনবিদিত। তেমনই কলকাতার চিনা বাসিন্দারাও কালীভক্ত হয়ে উঠেছেন। কলকাতার চায়না টাউনেই তৈরি হয়েছে চিনা কালীমন্দির।
চিনিদের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক সুপ্রাচীন। আজ থেকে দুশো-সোয়াশো বছর আগে এক ভাগ্যাহত চিনি ব্যবসায়ী কলকাতায় এসে পড়েন ভাগ্য পরীক্ষা করতে। ইছাপুরে কারবার জমিয়ে বসেন, সেই চিনি উৎপাদনের শুরু। অনেকেই বলেন চিন থেকে চিনি শব্দের জন্ম। তা ওই ভদ্রলোক টম অ্যাচিউয়ের কারবার আর দাঁড়াল না। তার কারখানার শ্রমিকেরা ছিল চিনি। তারা নিকটবর্তী শহর কলকাতায় খুঁটি গাড়ল। মধ্য কলকাতার টেরিটি বাজারে তৈরি হল প্রথম চিনে পাড়া। জমিয়ে উঠল ট্যানারির ব্যবসা। কিন্তু শহরের মধ্যিখানে এমন চামড়া কারবার ঠিক হজম করতে পারেননি ব্রিটিশরা। ফলে চিনেদের ভাগিয়েই দেওয়া হল। তারা গিয়ে উঠলেন শহরের বাইরে ট্যাংরা, তোপসিয়া অঞ্চলে। সেখানেই তৈরি হল চিনে পাড়া। আমাদের আজকের চিনে কালী মন্দিরটিও সেখানেই অবস্থিত।
এমনিতে চিনাদের মতোই কলকাতার চিনারা বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। ট্যাংরার একজন চিনা ব্যক্তিই এই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও তিনি ছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁর পরিবারই কালীমন্দিরটির যাবতীয় দায়িত্বে রয়েছে। এই মন্দিরটিই ট্যাংরার চিনে কালী মন্দির নামে পরিচিত। জয় কালী চাইনিজওয়ালি, কলকাত্তাওয়ালি! এক ডাকে সবাই আপনাদের চিনিয়ে দেবে এই মন্দির। ওই চিনা ব্যক্তির পরবর্তী প্রজন্ম সিন লি, তিনি মন্দিরের। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কার্তিক বা কুহু অমাবস্যায় এখানে ভক্তদের ভিড় বাড়ে। দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় খিচুড়ি, সবজি, পায়েস, মিষ্টি ও ফল। চিনারাও ওই ফলই খান। কথিত আছে, আগে এই মন্দিরের স্থানে ছিল একটি কালো পাথর। যাকে সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করতেন এখানকার ভক্তরা। একবার এক বালক অসুস্থ হয়ে পড়ে। বহু চিকিৎসককে দেখিয়েও কোন কাজ হয়নি। এই সময় ওই শিশুটির মা-বাবা তাকে পাথরটির কাছে নিয়ে আসে। তাতে বালকটি সুস্থ হয়ে যায়। এছাড়াও অনেকে মানত করে ভালো ফল পেয়েছেন। তারপরই এখানে মন্দির তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে কালীমন্দিরটি তৈরি হয়েছে, সেটি গ্রানাইট পাথরের। এখানে দুটো কালীমূর্তি রয়েছে, লাল শাড়িতে সাজানো দেবী। এছাড়াও, শিব থেকে হনুমান; মন্দিরে সকলেই বিরাজমান।
স্থানীয়দের মতে, মা কালী এখানে খুবই জাগ্রত। এলাকার মা, মেয়ে মহিলাদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়। স্থানীয় চিনেদের কথায়, স্বপ্নে এসে দেবী নিজেই বলেন, ইয়ে করনা হ্যায়, ওহ্ করনা হ্যায় সেই মতোই সব কাজ হয়। এই মন্দির গড়ার গোড়ার কথা না বললে গল্প অসমাপ্ত থেকে যায়, ট্যাংরার মঠেশ্বরতলা রোডে আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে এই কালী মন্দির তৈরি করেন এক চিনা ব্যবসায়ী। গত শতকের তিন-চারের দশক, প্রায় ৬০-৭০ বছর আগের কথা, ট্যাংরার ৯এ মঠেশ্বরতলা রোডে একটা অশ্বত্থ গাছের নীচে স্থানীয় লোকেরাই পাথরের ছোট্ট কালী মূর্তি রাখেন। তখন মন্দিরের চারিদিক খোলা এবং মাথার ওপরে অ্যাসবেস্টার। পুজো দিতে আসতে শুরু করেন স্থানীয় হিন্দুরা। তার দেখাদেখি, ওই অঞ্চলের চিনারাও ধীরে ধীরে ভিড় জমাতে শুরু করলেন। প্রথমে তারা পুজো দেখতে আসতেন না। তারপর স্থানীয়দের কাছেই শুনলেন, দেবী কালিকা সমস্ত বিপদ থেকে ভক্তদের রক্ষা করেন। এরপর চিনারা কালীভক্ত হয়ে উঠলেন। কালীর পুজোয় অংশ নিতে শুরু করলেন।
তেমনই এক চিনা ভক্ত ছিলেন ফাং চুং, দেবী কালী তার মানত পূর্ণ করেন। তিনি সফল ব্যবসায়ী হওয়ায় মায়ের কাছে ফিরে আসেন। মানত পূর্ণ হওয়ার কৃতজ্ঞতা জানাত ফাং চুং তখন পাকা ছাদওয়ালা এই মন্দির গড়ে দেন। সঙ্গে আরও একটা নতুন কালী মূর্তি ও শিবের মূর্তিও তৈরি করে দেন ফাং চুং। সেই সময় থেকেই এই চিনা মন্দিরে জোড়া কালী মূর্তি রাখা হয়ে আসছে। আর মন্দিরের নাম হয়ে গেল চাইনিজ কালী মন্দির। আধুনিক মন্দিরটি ১৫-১৬ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল।
নামে চিনা কালী মন্দির হলেও, হিন্দু রীতি অনুযায়ীই ফুল, বেলপাতা ও অন্যান্য উপচারে এখানে মায়ের পুজো করা হয়। বিভিন্ন রকম ফল ও মিষ্টি দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। মন্দিরের একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিতও রয়েছেন, প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় তিনি পুজো করেন। নিত্য পুজো হয়, ফলহারিণী কালীপুজোর মতো বিশেষ দিনে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়, কার্তিক মাসের কালীপুজোয় বড় করে পুজো হয়। দীপাবলির দিনে কার্তিকী অমাবস্যায় হয় জোড়া কালী মূর্তিতে পুজো হয়। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া হয়। কার্তিকী বা কুহু অমাবস্যা তিথিতে চিনা তন্ত্রীয় শাস্ত্র সূত্রে সিনিবালি অমাবস্যা চিরাচরিত হিন্দু রীতি মেনেই পূজিত হন চীনা মন্দিরের মা কালী। পুজোর দিন হিন্দুদের পাশাপাশি স্থানীয় চীনারা সকলেই মায়ের পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। পুজোয় প্রধান ভোগ খিচুড়ি, পায়েস আবার ভোগে চাউমিনও থাকে। এটাই চায়না টাউনের মহিমা। এই অনন্য নৈবেদ্যই মন্দিরটিকে আলাদা করে তোলে এখানে, ফল, মিষ্টি, বাতাসা এই মন্দিরে প্রসাদ আকারে দেওয়া হয়, আবার নুডল, চাউমিন, ফ্রাইড রাইস, মাঞ্চুরিয়ান এবং চপসুইও নিবেদন করতে হয়। তবে সেই নুডুলস নিরামিষ। অন্য সকল পূজার মতো ফল প্রসাদের সাথে নুডুলসকেও প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়। এখানে মন্দিরে হিন্দু রীতি অনুযায়ী সকাল-সন্ধ্যা আরতি করা হয়, আবার অশুভ শক্তি থেকে দূরে থাকার জন্য এখানে হাতে তৈরি কাগজ পোড়ানো হয়। দীপাবলির সময় এই মন্দিরের সামনে চাইনিজ ধূপকাঠি জ্বালানো হয় লাইন দিয়ে। বাংলায় মা কালী চিরকাল আমাদের ঘরের মেয়ে হিসেবে পূজিত হন, সেই মাকেই হিন্দু-চিনা একসঙ্গে পুজো দিচ্ছেন। এ চিত্র আজকের পৃথিবীতে আশার সঞ্চার করে আজও বলে যায় পৃথিবীটা সব্বার।