স্বর্গ কোনটি? এই প্রশ্নে একবাক্যে সবাই বলবেন কাশ্মীর। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা তার রূপ দেখেছেন তাদের কাছে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। কিন্তু চীনাদের কাছে তাদের বিশ্বাসে নিজস্ব এক স্বর্গ আছে। আর সেই জায়গা হলো চীনের সি চুয়ান প্রদেশের জিওজাইগো ভ্যালি। হিমালয়ের গহীনে লুকোনো এই ভ্যালি চীনাদের কাছে স্বর্গ।
এই ভ্যালির মাত্র ৫০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আছে ১৭ টি ঝর্ণা , ১১৪ টি বিস্ময়কর স্বচ্ছ জলের হ্রদ এবং সুন্দর বনাঞ্চল। জিওজাইগো ভ্যালি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মালভূমি অঞ্চলে থাকা বিস্ময়কর এক জলের রাজ্য। আর তাই চীনের জনপ্রিয় পর্যটন স্থল হিসেবে জায়গাটি পরিচিত হয়েছে।
অতীতে এই উপত্যকা ছিল সমুদ্রের তলদেশে - হিমালয়ের সৃষ্টির সময় তা এমন পর্বতের আকার ধারণ করেছে। এর ৮০০০ ফুট উচ্চতায় প্রাপ্ত জীবাশ্ম তার প্রমান। তিব্বতের মিন পর্বতমালার এক বিশেষ অংশ এই জিওজাইগো ন্যাশনাল পার্ক, যার আয়তন মাত্র ৭২০ বর্গ কিলোমিটার। এখানকার হ্রদগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। তার চারপাশে ঘিরে আছে পাহাড়ি বনভূমি। মাত্র ৫০ কিলোমিটারের ব্যবধানে এই জল ৬০০০ কিলোমিটার নিচে নেমে গেছে, আর চলার পথে সৃষ্টি করেছে অবিশ্বাস্য জলপ্রপাতের।
স্থানীয় মতে, এই জলপ্রপাত হলো এই অঞ্চলের প্রাণ। ৪০ বছর আগে চীন সরকারের এই অঞ্চল সম্পর্কে কোনোই ধারণা ছিল না। এই জায়গা অত্যন্ত দুর্গম, এমনকি এর নিকটবর্তী শহর থেকে ভ্যালি তে যেতে সময় লাগে ১০ ঘন্টা। কিন্তু ১৯৬০ এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ১৯৭৫ সালে চীনের কৃষি ও বনমন্ত্রণালয় এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনুভব করেন যে, অঞ্চলটি বনজ সম্পদ ও বিভিন্ন বন্য প্রাণী সমৃদ্ধ অভ্যয়ারণ্য| ১৪০ প্রজাতির পাখী,বহু কাঠবিড়ালি, অতিকায় পান্ডা ও নাক বোঁচা বাঁদর এখানকার বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও আছে মূল্যবান গাছ। কিন্তু দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যে চীন সরকার ১৯৮২ তে হেরিটেজ উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেন এই উপত্যকাকে।
এবার আসি এই নামের ব্যাখ্যায়। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই অঞ্চলের সৃষ্টি কর্তা ছিল ৯ জন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, সাহসী বোন। এই ৯ বোন এলাকার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ৯ জন তিব্বতি পুরুষকে বিয়ে করে এই উপত্যকা জুড়ে ৯টি পৃথক গ্রামে বসবাস শুরু করে। আর সেই থেকেই এখানকার নাম হয়েছে জিওজাইগো। চীন ভাষায় জিওজাইগোর অর্থ ৯ গ্রামের উপত্যকা। বর্তমানে এখানকার ৭টি গ্রাম আছে অক্ষত। আর এই সব গ্রামে মাত্র ১১০ টি পরিবার বসবাস করে। এই বাসিন্দারা এতটাই বিচ্ছিন্ন যে তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলে, নিজেদের মতো করে ভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা করে।
১৯৮৪ সালে এই জায়গাকে ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে। ২০১০ সালের মধ্যেই প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি পর্যটক জিওজাইগো ঘুরে গেছে। আর বর্তমানে প্রতিদিন ৫০০০ পর্যটক ভ্রমণের অনুমতি পান। অতীতের দুর্গম অঞ্চল এখন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
প্রায় ৫ লক্ষ বছর আগে বিশাল এক পাহাড় ধসে জিওজাইগোর একটি মুখ বন্ধ হয়ে জল জমে তৈরী হয় এক বিশাল হ্রদ - লম্বায় প্রায় ৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থে মাত্র ৫০০ গজ। স্থানীয় ভাষায় যা দীর্ঘ সাগর নামেই পরিচিত। এখানকার বাসিন্দারা সমুদ্র থেকে প্রায় ১৫০০০০ কিলোমিটার দূরে বসবাস করে। তারা এর থেকে বড় জলাশয় দেখে নি। তাই তাদের কাছে এই হ্রদই সাগর।
এখানকার অধিকাংশ হ্রদগুলি তৈরী হয়েছে ভূমিকম্পের ফলে। হ্রদের জল নানান রঙে সজ্জিত। অবশ্য তার কারণ জলের তলার শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ। স্থানীয়রা এসব নামকরণ করেন বেশ রঙিন ভাবেই, যেমন ‘টাইগার লেক, ময়ূর নদী, ড্রাগন লেক ইত্যাদি। এছাড়াও কিছু হ্রদের নাম হয়েছে জনশ্রুতি অনুযায়ী সেই সব হ্রদে কাল্পনিক ভাবে বাস করা পরীদের নামেও। হিমালয়ের অতি উচ্চতায় শীতকালে এখানকার জল জমে যায়, এছাড়া এই হ্রদগুলোতে মাছের সাক্ষাৎ পাওয়া বেশ ভার। এখানকার সবথেকে বড় আকর্ষণ চুনাপাথরের জলপ্রপাত - যার প্রস্থ ১০০০ ফুটের বেশি ও উচ্চতা প্রায় ৬৫ ফুট। বর্তমানে পর্যটন ব্যবস্থা বেশ উন্নত হয়ে উঠেছে। আর এই নৈঃস্বর্গিক রূপের টানেই পর্যটকুলের ভিড় লেগেই থাকে। তবে কাশ্মীরের মতো না হলেও চীনাদের স্বর্গের ছবি নেহাতই মন্দ নয়।