হুগলীর চুঁচুড়া। সাধুডাকে ‘চিনসুরা’। চিঁচড়া জাতীয় বেতগাছের জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং সেখান থেকেই এ শহরের নাম হয়েছে চুঁচুড়া।
বাংলায় ওলন্দাজদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। পর্তুগীজদের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল এক সময়। তখন চিনসুরার নাম ছিল ‘বক্সা বন্দর’।
তখন কলকাতা ‘কলকাতা’ হয়ে ওঠেনি। হুগলির চুঁচুড়া, চন্দননগর বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বর্হিবিশ্বের কাছে অনেক বেশি পরিচিত নাম। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং আমেরিকানদের আসা যাওয়া ছিল এখানে।
মোঘল কর্তৃক পর্তুগীজরা পরাজিত হলে ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজরা হুগলিতে আসে। তার অনেক আগেই অবশ্য ১৬০৬ খ্রীস্টাব্দে ওলন্দাজরা ভারতে এসেছিল।
সম্রাট শাহজাহান কুঠি পত্তনের সনদ দেন ১৬৬২ খ্রীস্টাব্দে। ওলন্দাজ নৌ-সেনাপতি ভ্যান ডার খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় কুঠি স্থাপন করেছিলেন।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভেরিনিগদি ওস্ত-ইন্ডিস কোম্পানি (ভিওসি) নেদারল্যান্ড এবং বাকি এশিয়ার মধ্যে একচেটিয়া ব্যবসা করত।
১৬৫৩ থেকে চিনসুরায় পরিবার নিয়ে বসতি গড়তে শুরু করে ওলন্দাজরা। মশলা, রেশম তন্তু, তুলো, আফিম রপ্তানির ব্যবসা শুরু হয়। আমস্টারডাম, বাটাভিয়া এবং চিনসুরার মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠে ডাচ কোম্পানীর মাধ্যমে। চিনসুরা হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র।
চুঁচুড়ার অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে ওলন্দাজরা ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। শিল্প- সাহিত্য তো বটেই স্থানীয় ভাষা এবং জীবন যাত্রার ক্ষেত্রেও। স্থানীয় বাঙালি এবং ওলন্দাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কও দেখা যেত। ওলন্দাজদের থেকেই প্রথম ছানার ব্যবহার শেখে স্থানীয় দুধ ব্যবসায়ীরা।
চুঁচুড়া শহরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তৈরি হয় গুস্টেভাস দুর্গ স্থাপন করে তারা। ওলন্দাজ গভর্নর লুই টেলিফার্ট এই সমাধি ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। প্রায় ৪৫ টি সমাধি ফলক ছিল এখানে। তার মধ্যে একটি সুসানা অ্যানা মারিয়া ইয়েৎস- এর। ১৮০৯ খ্রীস্টাব্দে তিনি মারা যান। মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। সুসানাকে বলা হত ‘ওয়াইফ অফ সেভেন ইউরোপিয়ান’। তাঁর জীবন নিয়েই রাস্কিন বন্ড লিখেছিলেন ‘ সুসানা’স সেভেন হাজব্যান্ড’। উপন্যাসটি পরে সিনেমাও হয় ‘সাত খুন মাফ’ নামে।
তবে গল্পকথা যাই বলুক না কেন, ঘটনা হল মাত্র দু’ বার বিয়ে করেছিলেন সুজান।
এই সমাধি এখন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্বাবধানে।
এক সময় ওলন্দাজদের প্রভাব কমতে শুরু করে। বাংলার নবাব আর ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধে তারা নিরপক্ষ অবস্থান নিলে রোষে পড়তে হয়।
১৭৫৯ সালে বিদেরার যুদ্ধে তারা ইংরেজদের কাছে হেরে যায়। তার পর থেকেই ওলন্দাজদের প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে। তারা ইংরেজদের বশ্যতা মেনে নেয়। ১৭৮১ থেকে ১৭৮৪ পর্যন্ত চিনসুরা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৮২৪ সালে ইংরেজ এবং ওলন্দাজ সরকারের মধ্যে ইঙ্গ-ডাচ চুক্তির মাধ্যমে উপনিবেশ হস্তান্তরিত হয়।
ওলন্দাজ সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায় ইংরেজদের ধরন-ধারণ। ইংরেজরা প্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে চিনসুরা শাসন করে। অদ্ভুত এক ডাচ-ইংলিশ-বাংলা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে চুঁচুড়ায়। আবার বনেদি বাঙালি আভিজাত্যর দ্যুতিও ঠিকরে বেরত দামী হীরের মতো।
চিনসুরার অন্যতম ‘সিগনেচার’ ঘড়ির মোড়। চিনসুরা অধুনা চুঁচুড়ার চারটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার সংযোগস্থল। এলিজাবেস্থের পুত্র ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের স্মৃতিতে তৈরি করা হয়। গথিক স্থাপ্তত্যে কাশট আয়রনে
ষন্ডেশ্বর শিবের মন্দির আছে। মন্দিরের আকর্ষণ দুটি বিশালাকার ব্রোঞ্জের ঢাক। ১৮০৩ সালে জে এন ব্রিজ দান করেন। ডাচ শাসক ব্রোঞ্জের পঞ্চ লিঙ্গ শিবও দিয়েছিলেন। গাজন উৎসবের সময় ঢাক বাজানো হয়। অপর একটি ঢাক ডাচ গভর্নর বাউকে ভ্যান দের পল দিয়েছিলেন।
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দে মাতরম’ লিখেছিলেন চিনসুরার জোড়াঘাটে। ১৮৮২ সালে আনন্দমঠ উপন্যাস যখন লিখছেন তখন চিনসুরার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে ছিলেন।
চুঁচুড়ার গঙ্গার তীরে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেই বাড়িটি বন্দে মাতরম ভবন নামে পরিচিত ছিল। এখন ‘চিনসুরা মিউজিয়াম’। চিনসুরার কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বহু কবিতার জন্ম দিয়েছিলেন সেখানে।