করোনা আবহে দ্বিতীয় ঢেউ ও তৃতীয় ঢেউয়ের সন্ধিক্ষণে স্বাধীনতা দিবসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার স্বাধীনতা দিবস-যাপন।
খুব ছোটবেলায় যখন স্কুল শুরু হয়নি তখন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাবার হাত ধরে গিয়েছি ক্লাবে। চারিদিকে নানা বয়সের বয়স্ক কাকু-জ্যেঠু-দাদু থেকে সমবয়সী কচিকাঁচাদের ভীড়। আমরা বন্ধুরা মেতেছি খেলায়। ওদিকে পতাকা উত্তোলনের প্রস্তুতি তখন তুঙ্গে।
প্রস্তুতি সমাপ্ত। সবাই কেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দড়ি টানা হল, তিন-রঙা পতাকা উড়ল আকাশে। ছড়িয়ে পড়ল ফুল। শুরু হল জাতীয়-সংগীত। ঠিক কবে থেকে মনে পড়ে না, হয়তো বা এই স্বাধীনতা-দিবস উদযাপন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, জাতীয়-সংগীত খুব শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার। জাতীয়-সংগীত শেষ হলে একে একে পাড়া-তুতো জ্যেঠু-কাকুরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে খুব কঠিন কঠিন ভাষায় অনেক কথা বলতেন।কিছুই বুঝতাম না। আজও হয়তো পারিনা। কি জানি!
সত্যিই কি স্বাধীনতার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছি আমরা? অনুভব করতে পেরেছি সেইসব মৃত্যুঞ্জয়ী দেশপ্রেমিকের আত্মদান? বুকের মধ্যে খুব গভীরে কখনো ভালোবাসা অনুভব করেছি আমার দেশের জন্যে? আমার দেশের মানুষগুলোর জন্যে? করিনি বোধহয়। সত্যিকারের ভালোবাসলে স্বাধীনতার ৭৪বছর পরেও দেশের এমন দুরবস্থা কেন? কেন এত দুর্নীতি, এত মিথ্যাচার, এত অভাব!
যাক্ সে কথা। বাস্তব বড় বেদনাদায়ক। তার চেয়ে স্মৃতি রোমন্থন করাই ভালো।
সেইসব বক্তৃতা শেষ হলে আমাদের হাতে দেওয়া হত একটা ঠোঙা। সে ঠোঙায় থাকত একটা করে সিংঙ্গাড়া আর একটা করে জিলিপি। সেই জিলিপির স্বাদ মিলেমিশে গেছে আমার স্বাধীনতা দিবসে।
ততক্ষণে আবার আগের মত আমরা ছত্রভঙ্গ - দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি খেলা শুরু। হাতে ৯ইঞ্চি/৬ইঞ্চির ভারতের জাতীয় পতাকার ক্ষুদে রূপ। সমস্ত খেলাধুলার মধ্যেও হাতে ধরা রয়েছে পতাকা। দৌড়চ্ছি আমি, দৌড়চ্ছে বন্ধুরা, উর্ধ্বশ্বাসে। হাতের পতাকা হাওয়ায় উড়ছে পত্-পত্ করে। এই হল স্বাধীনতা। তারপরও দৌড়েছি কতবার। এখনও দৌড়চ্ছি। জীবনের ইঁদুর-দৌড়ে। কিন্তু সেই ছোটবেলার মত স্বাধীন মনে হয় না আর নিজেকে। হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছি এমন হালকা আর লাগে না নিজেকে।
ইতিমধ্যে মঞ্চে শুরু হয়ে গেছে ঘোষণা - ' আর খানিকক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা'। দুদ্দাড়িয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হল পেনসিল, রবার, রঙ-পেনসিল সহ আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম। মাঠে বিছানো চটের আসন, তার ওপর সারি দিয়ে আমরা। ক্লাব-সংলগ্ন মাঠ ভরে গেছে কচিকাঁচায়। প্রতিযোগিতা শুরু, নির্ধারিত সময় এক ঘন্টা, কখনো বিষয় নির্বাচিত, কখনো 'যেমন খুশী, তেমন আঁকো'। কিন্তু ওই বিষয়ের ওপর আঁকতে পারিনি কোনোদিন; সাদা পাতা ভরিয়েছি পেন্সিলের দাগে, অযথা রবারের মোছামুছিতে সাদা পাতা তখন প্রায় ধূসর; সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, প্রাণপণে ঘষেছি রং, সর্বশক্তি দিয়ে। সময় শেষ হলে পাতা নিয়ে গেছে ক্লাবের কাকুরা। স্বাধীনতা দিবসের দিনগত কর্মকাণ্ডের এইখানেই ইতি।
বিকেলে দশগুণ উৎসাহে ফের জমা হয়েছি সেই ক্লাব-প্রাঙ্গণেই। এবেলা চটের আসন নেই, বদলে রাখা আছে চেয়ার। ক্লাবের একদিকে ক্লিপ দিয়ে টাঙানো হয়েছে দিনের বেলায় আমাদের আঁকা ছবি। সারি সারি ছবির মাঝে নিজের আঁকা ছবি দেখতে পেয়ে সে কি উল্লাস!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নামল, পাড়ার সব কাকু-কাকিমা, জ্যেঠু-জেঠিমা একত্রিত। মঞ্চে শুরু স্বাধীনতা দিবসের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উদযাপন। চেনা মুখের প্রমোদানুষ্ঠান। কেউ গাইছে "মুক্তির মন্দির সোপান তলে", কেউ নাচছে "কারার ঐ লৌহকপাট" গানের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান তো রয়েইছে। মধ্যে আবৃত্তি। সবশেষে নাটক। নাটকের বিষয়বস্তু কখনো সাঁওতাল বিদ্রোহ, কখনো শহীদ ক্ষুদিরাম আবার কখনো নেতাজীর জীবন। সমস্ত অনুষ্ঠান ধৈর্য্য ধরে দেখার সে এক উজ্জ্বল সন্ধ্যা।
সবশেষে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা, সঙ্গে পুরস্কার। না, না, শুধু প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় স্থানাধিকারীই যে পুরস্কার পাবে এমন নয়, সবাই পাবে - পেনসিল বক্স।
মঞ্চে উঠে পুরস্কার নেওয়ার সেই যে রোমাঞ্চ; হোক না সে সান্ত্বনা পুরস্কার, তাতে কি!
তারপর কেটে গেছে বহু বছর। স্বাধীনতার মানে হয়তো বুঝেছি, হয়তো বুঝিনি। ১৫ই আগস্টের মাহাত্ম্য বুঝেছি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে পড়েছি, পড়েছি বিপ্লবীদের জীবনী। কিন্তু এখনও স্বাধীনতাদিবস মানেই পাড়ায়-পাড়ায়, মোড়ে-মোড়ে "ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী", "অ্যা মেরে ওয়াতান কে লোগো"-র সুর মনে পড়িয়ে দেয় সেই ছোটবেলাকে। আর কে না জানে "শৈশবে আর ফেরা যায় না..."।