আকাশে পতপত করে উড়ছে তেরঙা পতাকা। আকাশের বুকে মুক্তির প্রতীক। জীবনের পথে স্বাধীনতার উচ্চতা। ছাদে উঠলে চোখ চলে যেত, বাড়ির পাশের মাঠের মাঝখানে বেদিটার দিকে।
কাঠ রঙের মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে। একটু পরেই মুড়ে ফেলা হবে সাদা কাপড় দিয়ে। স্বাধীনতার মত শুভ্র। এক ছুটে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়াতাম। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকতাম পতাকার দিকে। ক্ষুদ্র জীবন থেকে স্বাধীনতার উচ্চতা মনে হত এক আলোকবর্ষ দূরের।
আমরা যারা নব্বই দশকে জন্মেছি তাদের খোলা মাঠ ছিল। আকাশ ছিল। স্বাধীনতা দিবসের দিন সেই মাঠগুলো হয়ে উঠত মুক্ত-ক্ষেত্র। স্বাধীনতা দিবসের বেদির নিচে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতাম ভবিষ্যতের। বাধাহীন, চিন্তাহীন ভবিষ্যৎ। কোন স্বপ্নই দেখতে ভয় পেতাম না।
মাইকে গমগম করে বাজছে দেশাত্মবোধক গান। 'মুক্তির মন্দির সোপান তলে'। 'ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন'। কেউ একজন বক্তৃতা দিচ্ছেন। অতীতের স্বাধীনতা-সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের মাঝে সেতু গড়ে নিত আমার মন।
বক্তৃতা শুনতে শুনতে পাড়ি দিতাম কোনও এক রণাঙ্গনে। দৃপ্ত কণ্ঠে দেশের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে এগিয়ে আসছে একদল বিপ্লবী। তাদের হাতে লড়াইয়ের প্রতীক। তেরঙা পতাকা। শাসক ইংরেজ তখন গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে চাইছে তাদের শরীর। তাদের শক্তি। ইংরেজদের ছোঁড়া গুলি বিপ্লবীদের শরীর ভেদ করে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটুও কষ্ট দিতে পারছেনা বিপ্লবীদের। এমনই স্বপ্ন দেখতাম আমি। যে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেখানে কত শত বিপ্লবীর বলিদানের রক্ত লেগে রয়েছে। সেটা ভাবলেই শিরশির করে উঠত শরীর-মন। ইচ্ছে করত ইংরেজদের সব অত্যাচার যদি ফিরিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে বোধহয় স্বাধীনতার লড়াই-গাথা এত বেদনাদায়ক হত না।
পতাকা উত্তোলনের সময় গায়ে কাঁটা দিত। বক্তৃতা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে, বাড়ি ফিরতাম। শান্ত হয়ে বসে থাকতাম কিছুক্ষণ। মনে হত একটার পর একটা স্বাধীনতা দিবস পেরোচ্ছি আমরা। উদযাপন করছি শৃঙ্খল-মুক্তি। যাঁদের দীর্ঘ লড়াই আমাদের এই দিন দেখাচ্ছে, তাঁদের কথা কতটা মনে রাখছি?
বাবার পাশে বসে প্রশ্ন করতাম। আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার কথা। বাবা একটা অভ্যেস শুরু করিয়েছিল। আমায় স্বাধীনতা দিবসের দিন একেকটা বিপ্লবীর জীবনকাহিনী পড়ে শোনাত। লাইব্রেরী, ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা বিপ্লবীদের জীবনীমূলক বইগুলো তখন থেকেই অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠা শুরু হয়।
আজও কষ্ট হলে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সেইসব স্মৃতিই শক্তি যোগায়। আজ মাঠ নেই। মুক্ত আকাশ নেই। বয়স, চাকরি নানা ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা দিয়েছে।
কিন্তু স্বাধীনতা?
চিন্তায়, ভাবনায়, মননে স্বাধীনতার সেই অনন্ত পথে এগোতে পেরেছি কি?
এই প্রশ্নেরাই পাক খেয়ে চলে 'ছোটবেলার স্বাধীনতা'র কথা মনে পড়লে।