আমাদের তেরো পার্বণের বাইরে যে-দুটি পার্বণ সত্যিকারের সর্বজনীন, যেখানে ধর্মবর্ণের বর্ম বাঁধার বালাই নেই; তার একটি আমরা বাংলা মাসে যাপন করি, অন্যটি খ্রিস্ট মাসে। পঁচিশে বৈশাখ, আর, পনেরই আগস্ট।
পঁচিশে বৈশাখ আমাদের রবি ঠাকুরের জন্মদিন, পনেরই আগস্ট আমাদের স্বাধীনতার জন্মদিন।
স্বাধীনতার 'জন্মদিন'। হ্যাঁ, ছোটবেলায় তাই-ই মনে হত। ভেতরের কিছু না-বুঝেই মনে হত। এখনও হয়। কিছুটা বুঝে। ছোটবেলা থেকে কত্ত 'মনে হওয়া' বড় হতে হতে হু হু করে বদলে গেল; এটাই শুধু বদলাল না। এই এক বিষয়ে সেই 'ছোট আমি'র সঙ্গে আজকের এই 'ঢ্যাঙা আমি' এখনও সহমত।
ইচ্ছে করছে ফেলে আসা 'ছোট আমি'র সহচর হতে। হই...
ইচ্ছে করছে ছেড়ে আসা আমাদের গ্রামে যেতে। যাই...
গ্রাম। গ্রামের মধ্যিখানে শিব মন্দির। মন্দিরের সম্মুখে আটচালা। আটচালার সম্মুখে কাঠাখানেকের খোলা প্রাঙ্গণ। গাঁয়ের বসতি-বেষ্টিত ফাঁকা জায়গা বলতে ওইটুকুই।
সেটুকুর আকাশ পনেরই আগস্টের সকালে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ বালিকাগজের তিনকোনা অজস্র পল্লবে পল্লবিত হয়ে উঠত কাঁচাপাকা অগুন্তি হাতে। পাকা হাতেদের বয়স ওই...ধরুন...কুড়ি কিংবা একুশ। কাঁচাদের শুরু পাঁচ থেকে।
পাটের লম্বা লম্বা সুতলিতে কাঁচা হাতে আটার আঠা দিয়ে তিনকোনা রঙিন কাগজ সাঁটা হত। সে-কাজ শেষ হলেই ওই পাকা হাতেরা এর ছাদ থেকে ওর গাছে সেগুলো ক্রিসক্রস ঢঙে টাঙাতে নিদারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়ত। তাদের সেই রঙিন ব্যস্ততা অপার মুগ্ধচোখে দেখতে কী যে ভালো লাগত...
সাজানো হয়ে গেলে, সেই বরফি-ফোঁকর অসাধারণ সুন্দর ক্রিসক্রস সামিয়ানাটির তলায় দাঁড়িয়ে মনে হত, আজ যার জন্মদিন, সে মোটেই সাধারণ না। সে অপূর্ব সুন্দর। তবে সে নেহাত ছেলেমানুষও না। [এখন বুঝি, সে স্বাবলম্বীও না। তাকে সুস্থ-সতেজ-সবল-সচল রাখতে সত্যিকারের মনীষার বড় প্রয়োজন চিরকাল।]
ওই যে প্রাঙ্গণের পূব দিক, যেখানে গাছগাছালির ফাঁক বেয়ে রক্তলাল সূর্য ওঠে আজও, ওইখানে পতাকা উত্তোলন হত। পতাকার জন্য বেদি তৈরি হত। স্বাধীন ভারতের স্থায়ী পতাকার জন্য অস্থায়ী বেদি। ইট দিয়ে। তিন ধাপ। ফাগ দিয়ে রাঙানো। ফুল-মালায় সাজানো।
আমাদের কোন ব্যান্ড ছিল না। খালি পায়ে খালি গলায় আমাদের মিছিল বেরোত। তেরঙা পতাকা কাঁধে নিয়ে সম্মুখে থাকত একজন। তার পিছনে সদলে সার বেঁধে সমবেত আমরা। ছেলেমেয়েরা। পতাকাধারী বুকের ভেতর থেকে আওয়াজ তুলত, 'বন্দে মাতরম'! তুলত, শহীদ সংগ্রামী-বিপ্লবীদের নামে নামে জয়ধ্বনি। তাতেই রক্ত চনমন করে উঠত। দৃপ্তভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে অমনি আমরাও তার প্রতিধ্বনি তুলতাম। গমগম করে উঠত এ-পাড়া, ও-পাড়া, গ্রাম।
সমবেত স্বর শুনে নিত্যদিনের কাজ ফেলে দোরে উৎসুক চোখে বেরিয়ে আসত মা-কাকিমা-জেঠিমা-দিদি-দিদিমারা। তখন মনে হত যেন, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আমিই সংগ্রামী! সে যে কী উন্মাদনা, স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রাণোচ্ছলতা ভাষা দিয়ে বোঝানো যায় না!
মিছিল শেষ করে এসে দেশাত্মবোধক গান হত। হারমোনিয়াম আর তবলা বাজিয়ে। তবলা বাজাত বনানীদির বাবা সাধনকাকু। গাইত বনানীদি। দুর্লভ দরাজ গলা ছিল তার। উদাত্ত কণ্ঠে 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে' কী ভালো যে গাইত! বুকের ভেতর মাথার ভেতর রিমঝিম রিমঝিম সুর উঠত।
কত দিন ভুল জানতাম। নিজের মনেই ভেবে নিয়েছিলাম, 'কারার ওই লৌহকপাট' নজরুল লিখেছেন মানে, 'মুক্তির মন্দির সোপানতলে'ও বুঝি তাঁর লেখা। ভেবেছিলাম, অমন দৃপ্ত গান তিনি ছাড়া আর লিখবেনই বা কে! ভুল ভেঙেছিল অনেক পরে। জেনেছিলাম, গানটি শ্রদ্ধেয় গীতিকার মোহিনী চৌধুরির লেখা।
গান শেষ হলে গাঁয়ের বরিষ্ঠ কোন মানুষকে এ-দিন সম্মান জানানো হত। তাঁর হাত দিয়ে পতাকা উত্তোলন করিয়ে। তখন আবার 'বন্দে মাতরম' ধ্বনি উঠত। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিধ্বনি। পর পর তিনবার। সব শেষে সকলের হাতে বিস্কুট দেওয়া হত।
বিস্কুট নেওয়ার আগে আমরা পুষ্পাঞ্জলি দিতাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী ও শহিদদের স্মৃতিতে। তাঁদের ছবিতে।
বেদির ধাপে ধাপে বাঁধানো ছবি। ফুলে-মালায় সাজানো। নেতাজির দিল্লি চলো ছবি, ডান্ডিগামী গান্ধীজির ছবি আর সেই নিষ্পাপ-নির্লিপ্ত করুণ চোখের সদ্য যুবক,
শহিদ ক্ষুদিরামের ছবি।
কাছে এসে একে একে পুষ্পাঞ্জলি দিতে দিতে যখন ক্ষুদিরামের দিকে ফিরতাম, তখন তাঁর সেই মায়াময় চোখের দিকে তাকালেই বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে মুচড়ে উঠত। যে সদ্য যুবকটি যৌবনের মোহে জীবনের মায়া করল না, পথভ্রষ্ট হল না, নেতা হতে চাইল না, মাটির ঋণ রাখতে চাইল না; যে সকলের জন্য সর্বস্ব পণ করল, স্বাধীনতার প্রসব-যন্ত্রণার লগ্নে রক্ত দিয়ে শহিদ হল, হাসি মুখে ফাঁসির দড়ি গলায় নিল; সে কী মানুষ?
না। সে ভগবান। হ্যাঁ ভগবানই তো। আমার কাছে। মনে মনে আমার সেই ভগবানকে প্রার্থনায় জানাতাম, হে ভগবান, আজীবন তুমি আমার অন্তরে থেকো! অন্তরঘরে...