ছোটবেলায় ‘স্বাধীনতা দিবস’ কাকে বলে অত বুঝতাম না। আসল মজার বিষয় হল, স্কুলে সেদিন ক্লাস হবে না। কিন্তু সকালবেলায় উঠে সবাইকেই একবার স্কুলে যেতে হবে। মাস্টারমশাইরা আগে থেকেই বলে দিতেন, “কেউ যেন খালি হাতে না আসে।”
প্রত্যেককেই বাড়ি থেকে অল্প করে হলেও ফুল নিয়ে আসতে হবে। ভোরবেলায় উঠে নানারকম ফুল নিয়ে আমরা স্কুলে যেতাম। যে জায়গায় পতাকা উত্তোলন করা হবে সেই জায়গাটা ফুল ও আবির দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হত। চারিদিকে বেশ একটা খুশি-খুশি অথচ গম্ভীর ভাব।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাতটা।
হেডমাস্টারমশাই পতাকা উত্তোলন করতেন। পতাকার ভেতরে থাকত আমাদের সবার আনা হরেকরকম ফুল। পতাকাটা ওপরে উঠে যাওয়ার পর, যেই, তিনি দড়ি ধরে টান দিতেন, অমনি একরাশ ফুল চারপাশে ঝরে পড়ত ঝুরঝুর করে। শিশুমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত দেখে। তারপরেই শুরু হত জাতীয় সঙ্গীত।
সবাই মিলে ‘বন্দেমাতরম্’। কী বলছি, কেন বলছি অত বুঝতাম না। এই পর্যন্ত বেশ ভালোই চলত। তারপরেই শুরু হত মাস্টারমশাইদের বক্তৃতা। সেসব কথা আমাদের এক কান দিয়ে ঢুকত, আর এক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। শুধু ভাবতাম, কতক্ষণে বক্তৃতা শেষ হবে, আর আমাদের চকোলেট দেবে!
এইসব পর্ব মিটলে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করানোর পর দেওয়া হত লেবেঞ্চুস। এখনকার বাচ্ছারা বোধহয় তার নামও শোনেনি।
তখন পাঁচের মত দেখতে একরকম লজেন্স পাওয়া যেত। সেই ‘লেবেঞ্চুস’ নেওয়ার জন্য সে কী আকুল প্রতীক্ষায়!
একটা মুখে পুরে খেতে খেতে বাড়ি আসতাম। আর বাকিগুলো হাতেই থাকত। মনে হত, বাড়ি গিয়ে খাব। কিন্তু বাড়ি যখন পৌঁছতাম তখন সেগুলো গলে একাকার!
এখন সেসব ভাবলেই কেমন লাগে!
বাড়িতেও সেদিন অন্য আবহাওয়া। টিভিতে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। গমগম করত গোটা ঘর। বাড়ি ফেরার পর আরেকপ্রস্থ পতাকা টাঙ্গানোর পালা।
বাড়ির ছাদে আরও একবার জাতীয় সঙ্গীত ও বন্দেমাতরম্ গাওয়া হত সকলে মিলে। শ্রাবণের হাওয়ায় পত্পত্ করে উড়ত আমাদের তেরঙ্গা। টিভিতেও বেশ একটা দেশপ্রেমের আবহ। পাড়ার মাইকে ভেসে আসত ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’। দুপুরের দিকে বাজত ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’ অথবা ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম’।
স্বাধীনতা খায় না মাথায় মাখে, সেটা অত ছোট বয়সে না বুঝলেও আর দশটা দিনের চেয়ে যে এই দিনটা আলাদা সেটা বেশ বুঝতাম।
কোনও কোনও বাড়িতে দুপুরে আবার মাংস রান্নার আয়োজনও হত। টিভিতে সেদিন দেশাত্মবোধক সিনেমা অবধারিত ছিল। আরও একটু বড় হবার পর স্কুলে চকোলেটের পরিবর্তে লুচি আলুর দম দিত। তখন একটু একটু করে ডানা পাখা গজানোর ফলে ‘বন্দেমাতরম্’-এর সঙ্গে আলুর দমকে মিশিয়ে অপূর্ব ছড়া কাটা হত। সে ছড়া লেখার মত নয়। ছোটবেলার সেই অবুঝ দিনগুলো সত্যিই বড়ো মধুর ছিল।