ছোটবেলার স্বাধীনতা দিবস

"স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় বলো কে বাঁচিতে চায়" – রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়


১৫ আগস্ট, এটা এমন একটা বিশেষ কী দিন যে মানুষজন এত হৈ চৈ করে?
আজকে নাকি আমার দেশ স্বাধীন হয়েছিল। পাড়ার ক্লাবে সকাল থেকে গান বাজে মাইকে। গানগুলো ঠিক দুর্গা পুজোর সময় যে গানগুলো বাজে তেমন নয়। তবে শুনতে বেশ অন্যরকম একটা ভালো লাগে। যেমন – "মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান" লেখা আছে অশ্রুজলে অথবা "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"।

তখন কতই বা বয়স আমার, ছয় বা সাত। কিন্তু গানগুলো শুনলে কেমন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হত। এই গানটা শুনে মা বা ঠাকুরমাকে চোখের জল মুছতে দেখেছি। আমারও কেমন যেন কান্না পেত। পরে যদিও এই কান্নার সঙ্গে গর্ব মিশে গেছিল। সকাল নটা নাগাদ দাদা মানে আমার ঠাকুরদার হাত ধরে ক্লাবে যেতাম কারণ আমার ঠাকুরদা ছিলেন একজন গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং আমাদের পাড়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।

সেই কারণে  পাড়ায় পতাকা উত্তোলনের দায়িত্ব ছিল দাদার উপর। আর আমি দাদার সঙ্গে যেতাম কারণ ক্লাব থেকে সেদিন সব বাচ্চাদের জিলিপি আর একটা করে টফি দেওয়া হত। সেই জিলিপি আর টফির আকর্ষণ তো ছিলই পাশাপাশি দাদা যখন তিনরঙা পতাকাটা উত্তোলন করতেন আর উপর থেকে ফুলগুলো ঝরে পড়তো তার সঙ্গে পতাকাটা পতপত করে উড়ত, সেটা দেখতে অদ্ভুত ভালো লাগত। তারপর দাদা এবং পাড়ার বড়রা বক্তৃতা দিতেন।

সেটা যে খুব ভালো লাগত তা নয় কারণ খুব একটা বুঝতে পারতাম না তাদের কথা। তবে তখন থেকেই ক্ষুদিরাম বসু, বাঘাযতীন, বিনয় বাদল দীনেশ, ভগৎ সিং, প্রফুল্ল চাকী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘাযতীন–এদের নামগুলো শুনে শুনে মনের কোথায় যেন একেবারে ছবির মত আঁকা হয়ে গিয়েছিল বলা ভালো খোদাই হয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি গান্ধী, নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল– এদের কথাও শুনতে পেতাম। তবে বুঝতে পারতাম যে অসমসাহসী এই মানুষগুলোর জন্য আমরা একটা অমূল্য সম্পদ লাভ করেছি যার নাম স্বাধীনতা।

এরপর বড় হলাম। স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসে উঠলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়ে এবং বাড়িতে দাদার কাছে শুনে শুনে আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম যে স্বাধীনতার অর্থ কী, স্বাধীনতা দিবস ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং যে মানুষগুলো আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা কতোখানি শ্রদ্ধার পাত্র।
এটা বুঝতে শুরু করেছিলাম যে, নিজের দেশ সবার আগে। আমাদের দেশ বৃটিশদের অধীনস্থ ছিল দুশো বছরেরও বেশি সময়। এই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করেছিলেন আমার দেশ মায়ের বীর সন্তানরা। কত রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলেন তাঁরা!

কী রোমাঞ্চকর বীরত্বের কাহিনী বিনয় বাদল দীনেশের! ক্ষুদিরাম বসুর বয়স তো মোটে আঠেরো বছর মানে আমার থেকে বছর ছয়েকের বড়! কী দুর্জয় সাহস ছিল তাঁর যে হাসতে হাসতে প্রাণ দিলেন দেশের জন্য! নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু! রাসবিহারী বসু! নেতাজীর মহা নিষ্ক্রমণ! এদের জীবনকথা পড়তে পড়তে মনে হত যে এদের মতো মহান দেশপ্রেমিকরা যে দেশে জন্মেছেন আমি সেই দেশের মানুষ। ভাবলেই গর্বে বুক ভরে যেত।

তারপর আসত সেই বিশেষ দিন–১৫ আগস্ট। কী উত্তেজনা! আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস! আর সেই উত্তেজনার সঙ্গে মিশে যেত রোমাঞ্চ এবং গর্ব। এখন আমরা ১৫ আগস্ট স্কুলে যাই। পড়াশুনার ছুটি কিন্তু স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। সকালবেলা উঠে পরিষ্কার আয়রন করা ড্রেস আর ধবধবে সাদা কেডস পরে স্কুল যাওয়া আমার নিজের মাতৃভূমির স্বাধীনতা দিবস পালন করার জন্য। কোনও বইয়ের ব্যাগ নেই। এই আনন্দের কোনো তুলনা হয়!

স্কুলের মাঠে সব ছাত্রীরা লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়তাম। অন্যান্য দিন আমরা মানে ছাত্রীরা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেও আশ্চর্য্যজনকভাবে সেইদিন কিন্তু সবাই অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড থাকত। এখন বুঝতে পারি যে সেই বিশেষ দিনটার গর্ব আর রোমাঞ্চ শুধু আমার একার ছিল না। প্রত্যেক ছাত্রীর শিরা উপশিরা দিয়ে বইত স্বাধীনতার অহঙ্কার, উত্তেজনা, দেশের প্রতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বড়দিদিমনি এবং অন্যান্য দিদিমনিরা মাঠে এসে দাঁড়াতেন।
 স্বাধীনতার লড়াইয়ে যারা অংশ নিয়েছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে কি সুন্দর করে দু জন বা তিনজন দিদিমনি বলতেন। তারপর বড়দিদিমনি পতাকা উত্তোলন করতেন। আজ এত বছর পরও সেই মুহূর্তটার কথা ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে; তখনও উঠত।

তারপরেই পিটি দিদিমনি ড্রাম বাজাতেন আর আমরা একসঙ্গে "সারে জাহাঁ সে আচ্ছা" গাইতাম। লাইন করে ড্রামের বাজনার তালে তালে মার্চ পাস্ট করতাম, জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করতাম, সব শেষে একসঙ্গে জনগণমন অধিনায়ক জয় হে... এই তীব্র আনন্দের, রোমাঞ্চের কোনো তুলনাই হয় না!

তখন যেন মনে মনে আমরা কেউ হয়ে যেতাম মাষ্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সদস্য, কেউ মাতঙ্গিনী হাজরা, কেউ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কেউ আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন ফৌজি। বুঝতে পারতাম যে দেশকে স্বাধীন করার জন্য এই মানুষগুলো ইংরেজদের হাতে কতোই না অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। ঐ বয়সেই বোধহয় দেশকে সত্যিকারের ভালোবাসতে শিখেছিলাম; হয়তো বা শৃঙ্খলাবোধের পাঠও প্রথম পাওয়া। স্কুলেও আমাদের কেক, মিষ্টি দেওয়া হতো। সেই মিষ্টিও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে নিতাম আমরা। বাড়িতে ফেরার সময় হয় মনে মনে নয় জোরে জোরেই গেয়ে উঠতাম "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা"... বন্দে মাতরম।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...