শীতের বিদেশি ফুলের মধ্যে বাংলার শখের বাগানিদের কাছে চেরি গোল্ডের খুব কদর। কেননা, খুব সহজেই এই ফুল চাষ করা যায়। এবং পুরো শীত জুড়ে একটা গাছ থেকে অসংখ্য ফুল পাওয়া যায়। চেরি গোল্ডের অনেক নাম। কেউ একে ‘চেরি গাঁদা’ বলে ডাকেন, কেউ বলেন ‘ক্রাউন ডেইজি’। অনেকেই বলেন ‘চায়না গাঁদা’। যদিও আদিবাসস্থানের দিক থেকে এই গাছের সঙ্গে চিনের কোন সম্পর্ক নেই, এ-ফুলের আদিবাসস্থান আফ্রিকা। সেখান থেকেই দিকে দিকে ছড়িয়েছে এ-ফুলের গাছ। এ-ফুলের বিশ্বজনীন একটা গালভরা নাম আছে, সেটা হল, ‘ক্রিসান্থেমাম’।
দু’রকম রঙের চেরি গোল্ড মূলত আমরা এখানে দেখতে পাই। এক, পাঁপড়ি সাদা, মধ্যিখানে হলুদ; দুই, পুরোই হলুদ। এই দুই রকম রঙের আবার দুটো ভ্যারাইটি আছে। যথাঃ সিঙ্গল-পেটাল এবং মাল্টি-পেটাল। সাদা সিঙ্গল-পেটাল চেরি গোল্ড আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। ফুল তো নয়, যেন আস্ত এক ডিমের পোঁচ। চারিদিকে সাদা, মধ্যিখানে হলদে কুসুম। পাঁপড়ির বিন্যাস এক্কেবারে কসমসের মতো। আর মাল্টি-পেটাল দেখতে যেন ঠিক একেবারে থোকা সাদা গাঁদার মতো। কসমস ও গাঁদার অনেক গুণাবলীই অঙ্গে ধারণ করে এই ফুল অপরূপ সৌন্দর্যে আমাদের মোহিত করে।
চেরি গোল্ড শীতের রোদ খুব ভালোবাসে। তাই আপনার ছাদবাগান বা ব্যালকনিবাগানে যদি কমপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা বেশ ভালো রোদ আসে, তাহলে এই গাছ খুব ভালো হয় এবং প্রচুর ফুল দেয়। দোআঁশ মাটিতে এই ফুলের গাছ ভালো হয়। তাই এই গাছ রোপণের জন্য আপনার কাছে আগে থেকেই যদি দোআঁশ মাটি থাকে, তাহলে সেটা দু’ভাগ নিয়ে তার সাথে এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা কমপক্ষে এক বছরের পুরনো গোবর বেশ ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নেবেন। যদি আপনি এঁটেল মাটি সংগ্রহ করেন, তাহলে সেটা দেড় ভাগ নিয়ে তার সাথে দেড় ভাগ বালি ও এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা কমপক্ষে এক বছরের পুরনো গোবর সার বেশ ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে চেরি গোল্ডের উপযুক্ত দোআঁশ মাটি।
চেরি গোল্ড গাছ লম্বায় তিন ফুট পর্যন্ত বাড়ে এবং দারুণ ঝাড় হয়; তাই তাকে এভাবে বেড়ে ওঠায় সাহায্য করতে সাপোর্ট দিতে একটু বড় টবে চারা বসালে ভালো হয়। কমপক্ষে আট ইঞ্চি টবে এই গাছের চারা বসাবেন। তবে দশ বা বারো ইঞ্চির টব হলে সবচেয়ে ভালো হয়। আর পলিব্যাগে চারা বসালে, সেই ব্যাগের উচ্চতা হবে দেড় ফুট এবং তার মুখ হবে কমপক্ষে বারো ইঞ্চি। চেরি গোল্ড চারা অনেকেই সেপ্টেম্বর, অক্টোবর বা নভেম্বরে বসিয়ে ফেলেছেন। তা দেখে আপনি চিন্তা করবেন না, এখন চারা বসিয়েও বেশ ভালো ফুল পাওয়া যাবে। কোন অসুবিধা নেই। তবে এখন চারা নেবার সময় একটু বড়, মানে ইঞ্চি ছয়েক সাইজের চারা নেবেন। দেখে নেবেন, সেটা যেন পটে বা ছোট্ট পলিব্যাগে বসানো থাকে। তারপর তা বাড়িতে এনে নির্দিষ্ট সাইজের টব বা পলিব্যাগের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে আশিভাগ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে এক চিমটে ফাঙ্গিসাইড দিয়ে চারাটি সাবধানে মাটিশুদ্ধ পট বা পলি থেকে বের করে তাতে বসিয়ে দেবেন। বেশ ভালো করে জল দিয়ে দু’তিন দিন ছায়ায় রেখে তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকে টবশুদ্ধ গাছ ফুল সানলাইটে রেখে দেবেন।
চারা বসানোর পাঁচ-ছয় দিন পর থেকেই আপনি গাছের গ্রোথ দেখতে পাবেন। গাছ দুটো নতুন পাতা মেললে বা চারা বসানোর এক সপ্তাহের মধ্যেই গাছে কুঁড়ি দেখা দিলে ডগাটা হাফ ইঞ্চি ছেঁটে দিন। এভাবে পিঞ্চিং করলে গাছ খুব তাড়াতাড়ি ঝাঁকড়া হবে। স্বভাবতই গাছ যত ঝাঁকড়া হবে, তত বেশি ফুল পাওয়া যাবে। যেহেতু আমরা একটু দেরিতে চারা বসাচ্ছি, তাই এই একবারই পিঞ্চ করবো, আর করবো না। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে চারা বসালে ইতিমধ্যেই তিনবার পিঞ্চ করা যেত। তাতে গাছ দারুণ ঝাঁকড়া হয়ে যেত। যেহেতু শীত চলে গেলে আমরা আর ফুল পাবো না, তাই এখন চারা বসিয়ে মাত্র একবারই পিঞ্চ করবো। বেশি পিঞ্চ করলে ফুল পেতে দেরি হবে এবং অল্পদিন ফুল পাবো। তাছাড়া এই সময় একবার পিঞ্চ করার পর গাছ নিজের ছন্দে ফুল দিতে দিতে একইসঙ্গে বাড়তে থাকবে এবং ঝাঁকড়া হতে থাকবে।
চেরি গোল্ডের গাছ খুব শক্ত নয় এবং গাছ তিন ফুটের মতো লম্বা হয়। তাই গাছ যাতে বাড়ন্ত অবস্থায় ভেঙে না-পড়ে তার জন্য টবের মধ্যিখানে কাঠি পুঁতে তার সঙ্গে গাছ এবং ডাল সুন্দর করে বেঁধে দিতে হবে। ফুল ও পাতার ভার নিয়েও তারা যাতে সোজা হয়ে সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
চেরি গোল্ড যেমন রোদ ভালোবাসে, তেমনি জলও ভালোবাসে। মাটি শুকিয়ে আসছে দেখলেই গাছে জল দেবেন। টবের মাটি কাদা কাদা হয়ে থাকবে না সবসময়, আবার কখনই শুকনো হয়ে যাবে না। এই গাছ খুব খাবার খায়। মাটি তৈরির সময় যে কম্পোস্ট দেওয়া হয়েছিল, তা সে দশ-পনেরো দিনেই শেষ করে দেবে। তাই চারা বসানোর দিন দশেক পর থেকেই খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। জৈব ও রাসায়নিক খাবার অলটার করে দেবেন। সাতদিন পর পর। এক সপ্তাহে তিনদিনের সরষের খোলপচা জল পাতলা করে দেবেন, তো পরের সপ্তাহে ডিএপি (DAP) দেবেন টব প্রতি চার থেকে পাঁচ দানা গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে এবং সেটা দেওয়ার পরই হালকা করে মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। পনেরো দিন অন্তর নিয়ম করে একবার এনপিকে (NPK) সার অর্থাৎ নাইট্রোজেন, পটাশ ও ফসফেটের মিশ্রণ দেবেন। এক্ষেত্রে উনিশঃউনিশঃউনিশ অনুপাতের এনপিকে হাফ চা-চামচ টব-প্রতি প্রয়োগ করবেন। এই সারও গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে দেবেন। মাসে একবার প্রতি টবে দু’মুঠো করে কম্পোস্ট বা গোবর সার মাটির ওপর ছড়িয়ে দেবেন। এই সার মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখে, মাটির ভেজা ভেজা ভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে।
চেরি গোল্ডের ফুল শুকিয়ে এলে সেটা গাছে রেখে দেবেন না। কাঁচি দিয়ে বৃতি থেকে কেটে ফেলে দেবেন। গাছে ফুল শুকোলে গাছে ফুলের সংখ্যা কমে আসে। গাছ নতুন শাখার জন্ম দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তাই নিয়মিত শুকনো ফুলের ছাঁটাই চালিয়ে যেতে হবে। শীত শেষ হবার মুখে কিছু ফুল গাছে শুকনো করবেন। যেভাবে গাঁদার ফুল গাছে শুকিয়ে পরের বছর চারা তৈরি করে চাষ করার জন্য সংরক্ষণ করেন, সেভাবেই চেরি গোল্ডের ফুলও সংরক্ষণ করবেন। তাতে বর্ষার শেষদিকে নিজেই চারা ফেলে পরের বছর অনেক চারা তৈরি করে আপনার সাধের বাগান ভরিয়ে তুলতে পারবেন অসংখ্য চেরি গোল্ডের অপরূপ সৌন্দর্যে।
চেরি গোল্ডের গাছে দুটো পোকার আক্রমণ হয়। এক, মিলিবাগ; দুই, জাব। তবে এই দুই পোকা দমন করতে আলাদা করে কীটনাশক কেনার দরকার নেই। বাড়িতে থাকা যে-কোন শ্যাম্পু বা ডিটারজেন্ট পাউডার এক লিটার জলে আধ চা-চামচ ভালো করে ঝাঁকিয়ে গুলে স্প্রে করে দিলেই এই পোকারা মরে যায়। এক থেকে দু’দিন সকালে স্প্রে করে দেবেন, তাতেই হবে কেল্লাফতে। তাহলে আর কী, যেভাবে বললাম সেভাবেই শুরু করে দিন চেরি গোল্ডের চাষ আর তার সুন্দর সুন্দর ফুলে অপরূপ সজ্জায় সাজিয়ে তুলুন আপনার সাধের বাগান।।...