নাস্তিক পন্ডিতের ভিটের ঠিকানা পেরিয়ে এবার সন্মাত্রানন্দ পা রাখলেন অদ্বৈত বৈদান্তিক মধুসূদন সরস্বতীর ডেরায়। বাঙালি কে প্রাদেশিক বলে যতই গালমন্দ করা হোক না কেন আদতে বাঙালি অবশ্যই এক আত্মবিস্মৃত জাতি, দীপঙ্কর এর মতো সে ভুলে বসেছে নৈয়ায়িক মধুসূদন কেও। এক আশ্চর্য্য অতীন্দ্রিয় দৃশ্যকাব্যের অবতারণা করে এই আখ্যানের সূচনা করেছেন লেখক। এই আখ্যান কাব্যের প্রধান চরিত্র মধুসূদনের শিশুকালের নাম কমলনয়ন, যে চেয়েছিল কবি হতে। কিন্তু প্রথমে মধুসূদন হয়ে উঠলেন একজন নৈয়ায়িক আর দ্বিতীয়ে একজন অদ্বৈতবাদী, আর শেষে যেন কিছুই না হয়ে উঠতে পারার মধ্যেই জন্ম নেয় কিছু নতুন চরিত্র উৎপলদৃষ্টি অথবা পদ্মাক্ষ আর সেই চরিত্র গুলিই একটি সমান্তরাল জগতে হয়ে ওঠে কমলনয়নের প্রতিভূ। সেই অদ্ভুত জগতের পটে সেই চরিত্ররাই ফুটিয়ে তুলতে থাকে কমলনয়নের সমস্ত না হয়ে উঠতে পারা। কখনো এই আখ্যানকাব্যের সঙ্গী হয়েছেন ভারতসম্রাট আকবর অথবা সাধক তুলসীদাস আবার সেই সঙ্গে কালি আর কলম মন কে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে কাশির ঘাটে, কল্পলতার জালে প্রাণ পেয়েছেন কৃষ্ণ বিগ্রহ, আবার সেই বিগ্রহই কমলনয়নের কাছে ক্ষুধার্ত রূপে ধরা দিয়েছে, বায়না করেছে ক্ষুধা নিবৃত্তির, কালির আঁচড়েই রান্না হয়েছে ডাল ভাত আর তরকারি। অদ্বৈতবাদীর মানসে দ্বৈত ছায়ার জন্ম দেখেছেন লেখক, সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন অথচ তার ভারে ন্যুব্জ হওয়ার সুযোগ দেননি, পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে। সন্মাত্রানন্দর এই উপন্যাস জন্ম দিয়েছে এক পরাবাস্তব রোমান্টিসিজমের, এ যেন সেই মানুষদের গাথা যারা তাদের ধ্যানের ধন আগলে রাখেন, আপন খেয়ালেই তাদের মার্জনা করে চলেন অবিরত, আর একটি সমান্তরাল অধ্যায়ে লিখে চলেন না হতে পারার বিষাদ গাথা, জন্ম দেন মানস বন্ধ্যাত্বের প্রতিষেধক কে, এই উপন্যাসে কোথাও হয়তো মিশে আছে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরের কিছু না হয়ে উঠতে পারার এক অস্ফুট আর্তনাদ। পরিশেষে একথা বলাই যায় সন্মাত্রানন্দ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য আবিষ্কার, বাংলা সাহিত্যে যে ধারা স্রোতের সঙ্গী ছিলেন অবধূতের মতন সাধকেরা, সেই ধারা বহমান থাকবে সন্মাত্রানন্দের কলমে।