ঠোঁটের ওপরে এবং নাকের নীচে হাফ ইঞ্চি পুরু গোঁফ, বেশভূষায় সাহেবিয়ানা স্পষ্ট কিন্তু একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে তা জরাজীর্ণ, মাথায় ব্যাক হ্যাট আর হাতে ছড়ি - এ বর্ণনা শুনলে যে কেউই চক্ষু মুদে বলে দিতে পারবেন, তিনি স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র ওরফে 'চার্লি চ্যাপলিন'। ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহন করার সুবাদেই আজ তাঁর ১৩০ তম জন্মবার্ষিকী।
জন্ম এবং মৃত্যুর এতগুলো বছর পর আজও একইভাবে সমাদৃত হন তিনি, কারণ পৃথিবীতে যে জিনিস টি সবচেয়ে দুর্লভ, সেটাই তিনি তাঁর অবিস্মরণীয় পারফর্মেন্সের মাধ্যমে আপামর বিশ্ববাসীকে উপহারে দিয়ে গিয়েছেন- হাসি। যুদ্ধ পরিস্থিতি হোক অথবা জীবনধারার সামগ্রিক পরিবর্তন, সমসাময়িক যাবতীয় কঠিন মুহূর্তকে তিনি যাদুকরের মতো হাসিচ্ছলে বেঁধে ফেলেছিলেন নির্বাক সেলুলয়েডে, যা আজও প্রাসঙ্গিক এবং প্রখর।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাথে চার্লি চ্যাপলিনের প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাটি ছিল অনেকটা এইরকম- আইনস্টাইন চ্যাপলিনকে বলেছিলেন- “আপনাকে আমি যে কারণে খুব পছন্দ করি সেটা হলো আপনার বিশ্বজনীন ভাষা। আপনি যখন অভিনয় করেন, তখন আপনি হয়তো কোনো সংলাপই বলছেন না, কিন্তু সারা পৃথিবীর মানুষ ঠিক বুঝতে পারে আপনি কি বলতে চাইলেন এবং সেইজন্য তারা আপনাকে অসম্ভব ভালোও বাসে।' উত্তরে চ্যাপলিন হেসে বলেছিলেন- ‘ড. আইনস্টাইন, আপনাকে আমি তার চেয়েও মহৎ কারণে পছন্দ করি। আপনার থিওরি অফ রিলেটিভিটিসহ অন্যান্য গবেষণার বিন্দুবিসর্গও কেউ বোঝে না, তবুও গোটা পৃথিবীর মানুষ আপনাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে”। -তিনি ছিলেন এরকমই গভীর, বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রানোচ্ছল।
এই প্রতিভাধর অভিনেতার জন্ম ইংল্যান্ডের দক্ষিণ লন্ডনের ওয়েলওর্থের বার্লো স্ট্রিটে। চ্যাপলিনের বাবা চার্লস চ্যাপলিন আর মা হানা চ্যাপলিন দু'জনই ছিলেন শিল্পী যে কারনে স্বাভাবিকভাবেই চার্লির ভেতরেও শৈল্পিক দিকগুলো কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান নাট্যমঞ্চ ও মিউজিক হলে সূচীত চ্যাপলিনের দীর্ঘ ৬৫ বছরের কর্মজীবনের যবনিকাপাত ৮৮ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুতে। ১৯১৪ সালে চ্যাপলিন অভিনীত মুখ্য চরিত্র ভবঘুরে ‘দ্য ট্রাম্প’-এর স্রষ্টা তিনি নিজেই। চ্যাপলিন “শার্লট” নামে ছিলেন খ্যাত। তাঁর দীর্ঘ অভিনয় জীবনে তিনটি বাদে বাকি সব চলচ্চিত্রই ছিল নির্বাক, সেগুলি হল-
মেকিং এ লিভিং (১৯১৪), দ্য কিউর (১৯১৭), দ্য অ্যাডভেঞ্চারার (১৯১৭), এ ডগ’স লাইগ (১৯১৮),
দ্য কিড (১৯২১), দ্য গোল্ড রাশ (১৯২৫),
দ্য সারকাস (১৯২৮), সিটি লাইটস (১৯৩১)। চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম কথা বলেন ১৯৪০ সালে, 'দ্য গ্রেট ডিকটেটর' চলচ্চিত্রে। সে কি আর যেমন-তেমন কথা? মোটেই না। কারণ-
১৯৪০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ তিনি সাক্ষাৎ অ্যাডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দেন। ্তিনি ফ্যাসিস্টদের সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন। এই ছবি এবং চ্যাপলিনের অন্যান্য মুভমেন্টের মাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের সামনে ভেসে ওঠে চার্লির আগের নির্বাক চলচ্চিত্রগুলো, যেগুলোতে হাসিচ্ছলে তুলে ধরা হয়েছে শোষিত শ্রেণীর দুর্দশা, সমাজের শ্রমিক শ্রেণীর মানুষজনদের জীবনকথা এবং সমাজতন্ত্রের পরিকাঠামো।
অবশ্য ১৯৩৬ সালে 'গ্রেট ডিক্টেটর'-এর ঠিক আগেই তিনি আর একটি বিখ্যাত নির্বাক সিনেমা- 'মডার্ন টাইমস' বানিয়েছিলেন, যেখানে তিনি নিজের শাণিত বক্তব্যের চারা টি বুনে দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিলো এই মাস্টারপিস চলচ্চিত্রটি। এতে তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে বেকারত্বের উপর শিল্পায়নের প্রভাব তুলে ধরেন।
এসব দেখে শুনে রাজনীতিবিদরা তাকে কোনো প্রকারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করার জন্য বাহানা খুঁজতে থাকেন। অবশেষে ১৯৫২ সালে সেই সুযোগ আসে। মার্কিন সমাজে তার প্রতি তৈরি হওয়া বিদ্বেষী মনোভাব তিনি আঁচ করতে পারেন এবং তাঁর শৈশব, ক্যারিয়ার, জনপ্রিয়তার উত্থান-পতন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দ্য লাইমলাইট’ মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আমেরিকায় নয়, ছবিটি রিলিজ করবেন ইংল্যান্ডে। সেইমত তিনি ইংল্যান্ডে যান এবং আর আমেরিকায় ফিরে আসেননি। জীবনকে সর্বদা ইতিবাচক ভঙ্গিতে নেওয়াতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে চলে আসার পর তিনি সুইজারল্যান্ডে বসবাস শুরু করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় সেখানেই মারা যান বোবা-কমেডিতে 'বিশ্বরূপ' দেখিয়েছিলেন যিনি, সেই চার্লি চ্যাপলিন।