উল্কার মতো দুম করে পড়ে অথবা কোনও তাবড় ম্যাজিশিয়ানের ইন্দ্রজালীয় ম্যাজিকে জীবজগৎ সৃষ্টি হয়েছে, একটা সময়ে পৃথিবীর মানুষের যখন এই জাতীয় 'অন্ধ' উপলব্ধি ছিল, সেই সময়ে জীবনের রহস্য এবং সৃষ্টির মূল নিয়মকে বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন চার্লস ডারউইন। পৃথিবীতে জীবজগৎ সৃষ্টির রহস্যকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। তাঁর ‘বিবর্তনবাদ ও প্রাকৃতিক নির্বাচন’ সংক্রান্ত মতবাদ দিয়ে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের ধারণাটাই পুরোপুরি পালটে দিয়েছেন তিনি।
ডারউইনের পরিবারের সকলেই ছিলেন কৃতি। তাঁর ঠাকুরদাদা ইরাসমাস ডারউইন ছিলেন সেকালের তাবড় নিসর্গবিদ, কবি ও দার্শনিক। অন্যদিকে বাবা ও দাদা দুজনেই ছিলেন চিকিৎসক, ফলত একেবারে ছোট থেকেই তাঁর চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র ছিল উন্মুক্ত। ছোট্ট ডারউইন প্রকৃতির অপরূপ শোভা, বৈচিত্র্যের মধ্যে বিভোর হয়ে থাকতেন। প্রকৃতির কোলে লালিত এই জীবকুল কোথা থেকে এসেছে? কোথায়ই বা যায়? এই প্রশ্নগুলোই সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতো চার্লসের ভাবুক মনে। ঠাকুরদাদার প্রবল প্রভাব পড়েছিল তার চিন্তাভাবনায়। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় স্কুলের পাঠ শেষে ডাক্তারি পড়াতে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করে দেন তাঁর বাবা। এদিকে ডাক্তারি পড়ায় কিছুতেই মন বসাতে পারেনা ডারউইন, তাঁর মন পড়ে থাকে জীবজগৎ রহস্যের গভীরে। বাবা'কে সাহস করে জানালেন সেকথা। কিন্তু সেকথা শুনে তাঁর বাবা ছেলেকে ধর্ম যাজক করবেন বলে পাঠিয়ে দেন ক্রাইস্ট কলেজে, তখন তাঁর বয়স আঠারো। সেখানে গিয়ে শাপে বর পান চার্লস, হাতে পান প্রকৃতিবিদ্যার একখানা জুতসই বই আর পান উদ্ভিদবিদ্যার এক অধ্যাপককে। এখানেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় তাঁর। চার্লস ঠিক করেন বিভিন্ন দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াবেন এবং পেয়েও যান সে সুযোগ।
সেই সময়েই H.M Beagle নামে একটি ভ্রাম্যমান জাহাজের জন্য একজন প্রকৃতিবিদের খুব দরকার পড়ে। কলেজের অধ্যাপকের চিঠি নিয়ে চার্লস সটান হাজির হয় সেই জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে। ক্যাপ্টেন রাজি হলেন এবং জানিয়ে দেন বিনিময়ে কোনও বেতন তিনি দিতে পারবেন না। চার্লসের আপত্তি করার কোনও প্রশ্নই ছিল না কারণ তাঁর যা চাহিদা অর্থাৎ ঘুড়ে বেড়ানো, তা পূরণ হতে চলেছিল। ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার পথে রওনা দেয় জাহাজ।
দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে জাহাজটি দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল অঞ্চল, আগ্নেয়গিরি সঞ্চিত গ্যালাপাগস দ্বীপপুঞ্জ, তাইতিহি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাসমানিয়া, মালদিভ দ্বীপপুঞ্জ, সেন্ট হেলেনা প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। এই দীর্ঘ সময়ের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পুরোদস্তুর প্রাণিতত্ত্ববিদ হয়ে দেশে ফিরলেন চার্লস। ফিরেই সময় নষ্ট না করে তিনি তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতা আর গবেষনার কথা নিয়ে লিখে ফেলেন একটা বই। সেই বই তেমন সাড়া ফেলতে না পারলেও এর মাধ্যমেই তার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরী হয় ভূ-তত্ত্ববিদ চার্লস লায়ারের সঙ্গে। তখন চার্লস ত্রিশ-এর কোঠায়, সংসারী হয়েছেন এমমা ওয়েজউডের সঙ্গে। ছয় সন্তান আর ভরা সংসারের সঙ্গেই দীর্ঘ ষোল বছর ধরে বিবর্তনবাদ নিয়ে চলতে থাকে বিস্তর পড়াশোনা ও গবেষনা। সেই সময়ই তিনি একটি চিঠি পাঠান প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ ও তথ্যানুসন্ধানী অ্যালফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের কাছে। চিঠিতে নিজেদের ভাবনা আদান প্রদান করে তাঁরা এবং অদ্ভুতভাবে মিলে যায় তাঁদের মতামত। চার্লস আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন পরবর্তী বইয়ের ব্যাপারে। প্রকাশিত হয় 'দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস বা মিন্স অফ ন্যাচারাল সিলেকশন অর দ্য প্রিজারভেশন অফ দ্য ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ'- যা সংক্ষেপে 'অরিজিন অফ স্পিসিস' নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি জোরের সঙ্গে বলেন যে, জীবের সৃষ্টি কোনও স্বয়ংসৃষ্ট ব্যপার নয়, এর উদ্ভরের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, সে ইতিহাসকে পনেরোটি ভাগে ভাগ করে বুঝিয়েছিলেন তিনি।
প্রকাশের মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যে বইটির এক হাজার আড়াই শো কপি বিক্রি হয়ে যায়। রক্ষণশীল খ্রিস্টান ও বিজ্ঞানী উভয় মহলেই আলোড়ন ফেলে দেয় বইটি। স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণশীল ধর্মীয় মতবাদে জোরালো আঘাত হানে এই বই, তবে সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের কাছে প্রভূত সমর্থনও পান চার্লস।
ধীরে ধীরে প্রচারিত হয় ডারউইনের মতবাদ। তাঁর মতবাদের মূল কথা ছিল 'সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট' অর্থাৎ জীবজগতে অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য প্রতিমুহূর্তে চলছে সংগ্রাম এবং যাঁরা উপযুক্ত তারাই শেষত টিকে থাকে। পরে বেশ কিছু বিজ্ঞানীরা ডারউইনের মতবাদের কিছু জায়গা সংশধিত করেন, যা 'নিউ ডারউইনজিম' নামে পরিচিত। আজীবন জীবজগতের প্রতি গভীর ভালবাসা আর গবেষণায় নিজেকে জড়িয়ে রেখে সেই জীবজগতের মায়া ছেড়ে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল চলে যান 'আলোর দিশারী' চার্লস ডারউইন।