ইতিহাস রচনার পথে ভারতীয় দূত- বিক্রম ও প্রজ্ঞান

কাউন্টডাউন চালু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আর মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা, ভারতের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হতে চলেছে এক নতুন পালক। ভারতবাসী হিসাবে সকলেই অধীর আগ্রহে বসে রয়েছে কখন দুই ভারতদূত ‘বিক্রম’‘প্রজ্ঞান’ চন্দ্রপৃষ্ঠকে স্পর্শ করতে পারবে, তারই অপেক্ষায়। তাদের চোখ দিয়েই সমগ্র ভারত তথা পৃথিবীবাসী আবারও সাক্ষী থাকবে এক নতুন ধরণের চন্দ্র অভিযানের। এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় ফ্রেঞ্চ পরিচালক জর্জ মেলিয়ের ১৯০২ সালের বিখ্যাত নির্বাক চলচ্চিত্র লে ভয়েজ দানস লা লুন-এর কথা, যার ইংরেজি অর্থ আ ট্রিপ টু দ্য মুন

সাদা কালো ছবিতে যেমন ফুটে উঠেছিল সেই আপাত অভিযানের মজার দৃশ্য, তেমনি বিক্রম ও প্রজ্ঞান-জুটি আমাদের সামনে তুলে ধরতে চলেছে তারই বাস্তব রূপ। ৬ সেপ্টেম্বর, গভীর রাতে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর মাঞ্জিনুস সি আর সিম্পেলিয়াস এন- এই দুই গহ্বরের মাঝেই অবতরণ করার কথা বিক্রম ল্যান্ডারের। আর এই অবতরণ সফল হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চিনের পর বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদের মাটি ছোঁয়ার কৃতিত্ব অর্জন করবে ভারত।

অরবাইটার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর দুদফায় চাঁদের ৩৫x১০১ কিলোমিটারের কক্ষপথে পৌঁছেছে বিক্রম সারাভাইয়ের নামাঙ্কিত ল্যান্ডার- বিক্রম। শুক্রবার রাত পর্যন্ত ওই কক্ষপথেই ঘুরতে থাকবে। ইসরো জানিয়েছে, রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে চন্দ্রপৃষ্ঠের পথে নামা শুরু করবে বিক্রম এবং চাঁদের মাটি স্পর্শ করতে বাজবে প্রায় রাত দেড়টা থেকে আড়াইটেঅবতরণের অন্তিম ১৫ মিনিট ভারতের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান ও চিন্তার, কারণ এর মাধ্যমেই এই অভিযানের সাফল্য-ব্যর্থতা বিবেচিত হবে।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ এর আগে কখনো কোনো দেশ করেনি। তাই ভারতের জন্য বড়সড় সাফল্যের হতে চলেছে এই অভিযান। ল্যান্ডারের সঙ্গেই রয়েছে তিনটি ক্যামেরা। সেই ছবি দেখে জায়গা চূড়ান্ত করবেন বিজ্ঞানীরা। সেই তথ্য পাঠিয়েও দেওয়া হবে বিক্রমের কাছে। চাঁদের মাটিতে অবতরণের ১৫ মিনিট পরে চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি তুলে পাঠাবে বিক্রম। এরপর মোটামুটি চার ঘন্টার অপেক্ষা, ভোরের আলো ফুটবে একদিকে আর অন্যদিকে বিক্রমের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে প্রজ্ঞান রোভার। এক চন্দ্রদিবস অর্থাৎ পৃথিবীর হিসাবে পরবর্তী ১৪দিন ধরে চলবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

জলের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা তো চালাবেই প্রজ্ঞান তার সঙ্গেই খনিজের খোঁজ পাওয়া যায় কিনা, সেই বিষয়ও কিন্তু মাথায় রাখবেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়াও হিলিয়াম-৩ যা কিনা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ জ্বালানি হিসাবে অপরিহার্য বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, তার খোঁজও চলবে। এই অভিযান থেকে পাওয়া প্রতিটা তথ্য পরবর্তী সমস্ত গবেষনায় সাহায্য করবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বিজ্ঞানীমহলে।

ভারত থেকে মোট ১৩টি ও নাসার ১টি ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে চন্দ্রযান-২ রওনা হয়। চন্দ্রযান-১ এর সাফল্যের পর এই যাত্রা আরো অনেক গবেষণার পথ খুলে দেবে তা নিয়ে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা। ৯৭৮ কোটি টাকার ইসরোর এই প্রকল্প, ৪৮ দিনের সফর শেষে চন্দ্রযান-২ এর বিক্রম অবশেষে পদার্পন করতে চলেছে চন্দ্রপৃষ্ঠে।

২২শে জুলাই শ্রীহরিকোটা থেকে বাহুবলী রকেট শুরু করে তার যাত্রা। এর আগে ইসরোর কোনও যান কোনও মহাকাশ অভিযানে সফট ল্যান্ডিং করেনি। এবার এমন জায়গায় নামতে চলেছে ল্যান্ডার, যেখানে কোনও বায়ুমণ্ডল নেই। শুধুমাত্র প্রোপালশন সিস্টেম কাজে লাগিয়ে গতিবেগ কমাতে হবে এবং নিরাপদে অবতরণ করতে হবে। ইসরোর এই কর্মযজ্ঞের ফলাফল দেখতে বেঙ্গালুরুতে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদী। দূরদর্শন ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতো বেশ কয়েকটি চ্যানেল টেলিকাস্ট করবে গোটা পর্ব। এই উপলক্ষ্যে ভারতে এসেছেন নাসার বিজ্ঞানীরাও।

ইসরো টুইট করেছে একটি ছবি যা ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে লুনার অরবিটার ও ল্যান্ডার বিক্রমের একটি কথোপকথন, যেখানে প্রথম জন উইশ্ করছে পরের জনকে তার সাফল্যের কামনা করে।

নীল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স এই ত্রয়ী যে ইতিহাস রচনা করেছিলেন ১৯৬৯-এ, তা ২০১৯ -এ দাঁড়িয়ে আবার সফল করতে চলেছে দু'টি রোবট। একদিন চাঁদই হতে পারে বিশ্ববাসীর নতুন ঠিকানা। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর তুলনায় অনেক কম, তাপমাত্রা অনেক বেশি, তার সাথে রয়েছে ডাস্ট পার্টিকেল- তবে এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে বদ্ধপরিকর এই দুই সঙ্গী। তারা হয়তো আর ফিরবে না কোনোদিনই, কোনো এক সময়ে হঠাৎ দেখা হবে চাঁদে অবতরণ করা কোনো এক মহাকাশকারীর সঙ্গে, তবে তাদের সাফল্যে মুখর হবে সমগ্র দেশবাসী। এই ল্যান্ডমার্ক মিশনের দুই প্রধান চরিত্রের দিকেই এখন নজর বিজ্ঞানীদের ও তাদের সাফল্যের কামনা করছে সমগ্র ভারতবাসী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...