মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণ-পথের প্রথম আলো চন্দ্রমুখী বসু

প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে আমরা কার নাম জানি? অবশ্যই কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। শিক্ষার পথ কোনদিনই মেয়েদের জন্য খুব একটা সহজ ছিল না। সেই পথ মসৃণ করার লড়াই লড়েছেন অনেকেই। প্রথমাদের নাম মোটামুটি পরিচিত সকলের কাছে। তবে সেই প্রথমা পর্যন্ত পৌঁছতে একটা পথ পেরোতে হয়েছে সকলকেই। সেই পথে ছড়িয়ে থেকেছে এমন অনেক গুণী মানুষের নাম যা হয়তো ইতিহাসে বিস্মৃত। কোথাও বা উপেক্ষিত। ‌তবুও অবহেলিত সেসব নাম কখনো জায়গা করে নেয় ইতিহাসের কোনও ছোট্ট প্রান্তে। তেমনই এক নাম চন্দ্রমুখী বসু।

১৮৬০ সালে জন্ম। বর্তমান বাংলাদেশে। বাবা ভুবন মোহন বসু। বাবা ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ব্রহ্মদেব উপাধ্যায়ের প্রভাবে হিন্দু ধর্মের প্রতি নিরাসক্ত হয়েই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন চন্দ্রমুখী বসুর বাবা। মূলত খ্রিস্টধর্ম প্রচার এর লক্ষ্যেই বাংলাদেশ থেকে সুদূর দেরাদুনে সপরিবারে এসেছিলেন চন্দ্রমুখী বসুর বাবা।

পড়াশোনার প্রতি এ মেয়ের আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়েছিল দেরাদুনে। মূলত মিশনারিদের তত্ত্বাবধানেই শুরু হয়েছিল পড়াশোনা। খ্রিস্টধর্ম প্রচার-এর লক্ষ্যেই বাবার আসা, তাই মূলত দেরাদুনে পড়াশোনা শুরু হয় ভুবনমোহন বসুর মেয়ের। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হলেও মেয়ের ইচ্ছে আরও পড়ার। বেথুন স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করার লক্ষ্যে চন্দ্রমুখী বসুর বাবা তাঁকে নিয়ে আসেন কলকাতায়। ইচ্ছে ছিল এফ. এ. পরীক্ষা দেওয়া। কিন্তু চন্দ্রমুখী বসু বেথুন স্কুলে ভর্তি হতেই পারেননি। আসলেই বেথুন স্কুলের কার্যনির্বাহী সমিতির নিয়ম ছিল, মিশনারি সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র বাবার খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের কারণে এই মেধাবী ছাত্রী ফিরে যায় দেরাদুনে। সেখানে মিশনারি ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট করা স্কুলেই আবার পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা জেদ কাজ করছিল। সঙ্গী ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করার ইচ্ছে। ১৮৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর চন্দ্রমুখী বসু এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে চেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু তখনও তাঁকে রেজিস্টার্ড পরীক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা যায়নি। কারণ তিনি যে মেয়েমানুষ। কোন মেয়েকেই পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু হাল ছাড়েননি চন্দ্রমুখী বসু। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরেও বারবার একই আবেদন করছিলেন। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে আনরেজিস্টার্ড পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান চন্দ্রমুখী বসু। মানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রেজিস্টার তালিকায় চন্দ্রমুখী বসুর নাম উল্লেখ থাকবে না। তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরীক্ষা দিতে পেরেছিলেন তিনি। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রতিটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী বসু।

এদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে সমস্ত উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের নামের তালিকা প্রকাশিত হলো 'অল পার্সনস' ক্যাটাগরিতে। এখানেও সেই বঞ্চনা। পার্সনস অর্থাৎ পুরুষ। কোন মেয়ে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরীক্ষা দিলেও তার উত্তীর্ণ হওয়ার খবর বিজ্ঞপ্তি হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার কোন নিয়ম ছিল না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে।

বেশ কয়েক বছর পরে ১৮৮২ সালে পরের বছরের পরীক্ষা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তির ধরন বদলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কাদম্বিনী বসু, অবলা দাশ সকলের অনেকদিনের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের ফলে মহিলা পরীক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান। আনুমানিক দিনটি ছিল ২৭ মার্চ। সেই সময় বিজ্ঞপ্তির ধরন বদলে দাঁড়ায় 'অল পার্সনস এন্ড উইম্যান আর অ্যালাউড'। ১৮৮৩ সালে সাফল্যের সঙ্গে প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট হন কাদম্বিনী। আর ১৮৭৯ সালে, মানে চার বছর আগের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট চন্দ্রমুখী বসু নাম থেকে যায় আড়ালে। কাদম্বিনীর স্নাতক হওয়ার খবর পেয়েই আরেকবার আবেদন করেছিলেন চন্দ্রমুখী। আর্জি মঞ্জুর হয়েছিল ততদিনে। তাঁকে স্নাতক ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তুু আজ প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে নাম শোনা যায় শুধুমাত্র কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়-এর। ‌চন্দ্রমুখী বসুর লড়াই কোথাও রয়ে গিয়েছে আড়ালে।

এত কিছুর পরেও থেমে থাকেননি চন্দ্রমুখী বসু। তিনি এমএ পরীক্ষা দেন। এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ভারতের প্রথম মহিলা চন্দ্রমুখী বসু। পরবর্তীকালে তিনি বেথুন কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তারপর অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। কিন্তু এই সময় থেকেই তাঁর স্বাস্থ্যের কিছু সমস্যা শুরু হয়। ফলে কলকাতা থেকে ফিরে আসেন দেরাদুনে। সেখানেই কেটেছিল পরবর্তী জীবন। আজও প্রথম গ্র্যাজুয়েট হিসেবে আমরা কাদম্বিনী বসুর নাম পাই। চন্দ্রমুখী বসুর নাম কিছুটা হলেও উপেক্ষিত।

তবে খুব সম্প্রতি বেথুন কলেজের লাইব্রেরীর পুরনো নথি থেকে চন্দ্রমুখী বসুর নাম পাওয়া গেছে। চন্দ্রমুখী বসুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল দীর্ঘ আলোচনার জন্য। গবেষণা শেষে চন্দ্রমুখী বসুকে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট-এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ‌ এমনকি তাঁর পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরিদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস হয়তো সংশোধিত হয়েছে এতদিনে। কিন্তু কিছু উপেক্ষিত অধ্যায় অবহেলার গাথা সাজায়। যা কোথাও আমাদের অতীতের প্রতি আগ্রহী করে তোলে বারবার।

আজ নারীশিক্ষার পথ প্রশস্ত ও উন্নত। তাতে কোনও বাধা তেমনভাবে নেই এখন। কিন্তু যাঁরা এই বাধা কাটিয়ে আমাদের সামনে এমন মসৃণ পথ তৈরি করে দিয়েছেন, তাদের জীবন-গাথা অবহেলিত না থাকাটাই কাম্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...